থানা-ফাঁড়িতে লুণ্ঠিত ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে
যৌথবাহিনীর অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু, চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিক উস্কানি দাতাদের তালিকা চূড়ান্ত

দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশে একযোগে শনিবার সন্ধ্যা থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। শুরুতেই গাজীপুরে এক জন সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ কে আটক করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলামসহ চার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে। দেশব্যাপী চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। সম্প্রতি দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, নাশকতা, সরকার বিরোধী লিফলেট বিতরণসহ নানা উস্কানীমূলক কর্মকাণ্ড ও গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার প্রেক্ষিতে এই অভিযান। অভিযানের লক্ষ্য অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ, নাশকতাকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবের সময় থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি বিতর্কিত একটি পার্টির পলাতক কিছু নেতাকর্মী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার বিরোধী নানান ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে উস্কানীমুলক বক্তব্য দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের এসব উস্কানীমূলক বক্তব্য শুনে দেশে থাকা ওই পার্টির নেতাকর্মীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সম্প্রতি মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেন বেশকিছু দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিদেশে পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ।
গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম একটি গ্রুপে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘আমাদের টিম রেডি, রাজধানীতে রাতে মানুষ ঘুমাতে পারবে না। কোথা হতে কি করতে হবে, অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা মূল ম্যাসেজটা পাইবেন। আমরা প্রমাণ করে দিতে চাই, আমরা কার সৈনিক।’
ফেসবুক লাইভে এসে উস্কানীমুলক বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীর কবীর নানক। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার উস্কানী ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার হয়। এছাড়াও আরও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্র লীগরে সাবেক কয়েকজন নেতা উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের ওইসব বক্তব্য শুনে এতে বিতর্কিত পার্টির কিছু নেতাকর্মী বিভ্রান্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে নানামুখী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে ওইসব নাশকতা ও বিশৃঙ্খলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ পাশাপাশি যারা বিভিন্ন দলীয় পরিচয় বা অন্যকোনো পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সরকারের কমপক্ষে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা জেলা ও এলাকাভিত্তিক দুষ্কৃতকারী, নাশকতাকারী এবং চাঁদাবাজদের তালিকা প্রস্তুত করেছে। ওই তালিকা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও যৌথবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। যৌথবাহিনী তালিকা ধরে তাদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে অভিযান শুরু করেছে।
শনিবার তথ্য অধিদপ্তর ‘গাজীপুরসহ সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু শিরোনামে এক তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে শনিবার থেকে গাজীপুরসহ সারাদেশে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বিষয়ে আজ রবিবার প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর এবং কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনার পর সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযান শুরু করছে যৌথ বাহিনী।
শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সাল হাসানের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় আজ (শনিবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর আশ্বাসের কয়েক ঘণ্টা পরই অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে গিয়ে ওই আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গাজীপুর নগরের ধীরাশ্রম দাক্ষিণখান এলাকায় মোজাম্মেল হকের বাড়ি ভাঙচুরের খবর পেয়ে ঠেকাতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন। পরে সেখানে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে স্থানীয়রা তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় আহতদের সবাইকে প্রথমে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।শনিবার মধ্যরাতে গুরুতর আহত সাতজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওই হামলার প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে জাতীয় নাগরিক কমিটি গাজীপুর জেলা ও মহানগর শাখার আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে নগরের ভাওয়াল রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন নেতাকর্মীরা।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলার পুলিশ সুপার জানান, আমরা সশস্ত্রবাহিনী, বিজিবি, আনসারসহ সকল বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে এই অভিযান পরিচালনা করবো। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তারই হবে এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য।
এদিকে অপারেশন যৌথবাহিনীর অপারেশন ডেবিল হান্ট শুরুর প্রাক্কালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে এবং ষড়যন্ত্রমূলক অডিও রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক উস্কানি দিচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার উস্কানিতে ইতোমধ্যে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারাদেশে গুপ্ত হামলা, ঝটিকা মিছিল ও গণসংযোগ শুরু করেছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রক্তপিপাসু আওয়ামী দুর্বৃত্তরা গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর নারকীয় আক্রমণ চালিয়েছে। ১৫ জনের বেশী গুরুতর জখম হয়েছেন। পতিত সরকারের গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর ফ্যাসিস্টদের নিয়ে ভার্চুয়ালী মিটিং করে বলেছেন, ‘যে শহরে আমরা দিনের বেলা ঘুরতে পারি না সে শহরের কাউকে আমরা ঘুমাইতে দিব না’। লীগের নয়া প্রোজেক্টের মাস্টার প্ল্যানারদের একজন সে। এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে এখনো গ্রেফতার করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। দুর্নীতির মাফিয়া চক্রের অন্যতম শিখন্ডি পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে ষড়যন্ত্রমূলক সভা করছেন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই গণহত্যার বিচার হতে হবে। কিন্তু আসামিদের গ্রেপ্তার, জেলে ও দেশের বাইরে রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সচিবালয়ে গিজগিজ করছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা। পুলিশ-প্রশাসন-আদালতে তারাই সবকিছু করছে। অবিলম্বে ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আবারো হাসিনার দোসরদের পরাস্ত করা কঠিন হবে। বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যৌথবাহিনীর এই অভিযান অত্যন্ত ইতিবাচক।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অপারেশন ডেভিল হান্টকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এ বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তা বিবেক ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে অনেকটাই সমর্থনযোগ্য নয়। এ সমস্ত কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই কোনো দায়িত্বশীল নাগরিক সম্পৃক্ত হতে পারেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সবাই মিলে জোর দাবি তুলি, গত ১৫ বছরে যারা খুন, গুম, লুটপাট, দুর্নীতি বিশেষভাবে ২৪ এর গণহত্যা সংঘটিত করেছে, অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার এবং সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আশা করি সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের পক্ষে থাকবেন। নাগরিকদের জানমাল, নিরাপত্তা, ইজ্জত-আব্রু এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। জামায়াতে ইসলামির নেতাকর্মীগণকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনো অপশক্তি দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে।
গোলাম পরওয়ার দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। একই সঙ্গে পাচার ও লুণ্ঠনের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা, নিরীহ জনগণের জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান করা এবং দ্রুত এদের বিচার করা।