নিষিদ্ধ পলিথিনের দাপট, রুখবে কে?
পলিথিন—দৃষ্টিতে নিরীহ, ব্যবহারে সহজ, কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে ভয়াবহ এক পরিবেশঘাতী উপাদান। দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরে নীরবে ঢুকে পড়া এই প্লাস্টিক পণ্যটি আজ বাংলাদেশের পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার জন্য এক স্থায়ী হুমকিতে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, বহু আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও পলিথিনের দাপট যেন দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—নিষিদ্ধ পলিথিনের এই সর্বব্যাপী দাপট রুখবে কে?
পলিথিন কোনো সাধারণ বর্জ্য নয়। এটি এমন একটি প্লাস্টিকজাত বস্তু, যা প্রাকৃতিক পরিবেশে পচে যায় না, গলে যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পলিথিন ব্যাগ সম্পূর্ণভাবে অবক্ষয় হতে সময় নেয় প্রায় ১০০ থেকে ৪৫০ বছর। অর্থাৎ আজ আমরা যে পলিথিন ফেলছি, তা হয়তো কয়েক শতাব্দী পরও আমাদের মাটি, পানি আর পরিবেশকে বিষিয়ে তুলবে। মাটির উর্বরতা নষ্ট করা থেকে শুরু করে জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া—সব ক্ষেত্রেই পলিথিন ভয়াবহ ভূমিকা রাখছে।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়া: দেশ এবং জনগণের নেত্রী
পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব কেবল মাটিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। খোলা জায়গায় পলিথিন পোড়ানো হলে তা থেকে নির্গত হয় ডাইঅক্সিন ও ফিউরানের মতো বিষাক্ত গ্যাস, যা মানবদেহে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অথচ শহর কিংবা গ্রামের অলিগলিতে এই দৃশ্য নতুন নয়—বর্জ্যের স্তূপে আগুন জ্বলে, আর সেই ধোঁয়া নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে আমাদের ফুসফুসে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে চোখ রাখলেই দেখা যায় পলিথিনের সর্বগ্রাসী উপস্থিতি। রাস্তার পাশে, ড্রেনে, খালে, নদীতে কিংবা উদ্যানগুলোতে জমে থাকা পলিথিনের স্তূপ এখন যেন স্বাভাবিক দৃশ্য। বর্ষা মৌসুম এলেই এর ভয়াবহ রূপ আরও স্পষ্ট হয়—ড্রেন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। পরিবেশের দৃশ্যমান সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নোংরা, আবর্জনায় ভরা পরিবেশে বসবাস মানুষের মধ্যে বিরক্তি, হতাশা ও অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে—যা সামগ্রিক সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি।
আরও পড়ুন: প্রত্যাবর্তনের রাজনীতি: তারেক রহমান ও নেতৃত্বের ভাষান্তর
পলিথিন মাটিতে পড়লে সেটি শুধু একটি বর্জ্য হিসেবেই পড়ে থাকে না; বরং এটি মাটির স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতায় হস্তক্ষেপ করে। মাটির ভেতরে থাকা সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো—যার মাধ্যমে পানি ও বাতাস চলাচল করে—পলিথিনের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মাটির ভেতরের বায়ু চলাচল ব্যাহত হয়, শিকড় পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ফসলের উৎপাদনে।
পলিথিন মিশ্রিত মাটিতে পানির স্বাভাবিক শোষণ ক্ষমতা কমে যায়। কোথাও অতিরিক্ত পানি জমে থাকে, কোথাও আবার প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ধরে রাখা যায় না। এর ফলে জমিতে ফসল রোপণ, সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা- সবকিছুতেই বাড়তি জটিলতা তৈরি হয়। বিশেষ করে ধান, সবজি ও শাকজাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব দ্রুত চোখে পড়ে।
আরও উদ্বেগজনক হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় পলিথিন ভেঙে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়—যাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটির সঙ্গে মিশে উদ্ভিদের শিকড়ের মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে। অর্থাৎ যে ফসল আমরা খাচ্ছি, তার ভেতরেও অদৃশ্যভাবে ঢুকে পড়ছে প্লাস্টিক কণা। এটি শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, বরং একটি সম্ভাব্য জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিও।
পলিথিন মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় আরেকটি কারণে। এটি মাটির ভেতরের উপকারী অণুজীবের কার্যক্রম ব্যাহত করে। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক—যারা জৈব পদার্থ ভেঙে মাটিকে উর্বর করে তোলে—পলিথিনে আচ্ছাদিত পরিবেশে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে মাটি ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়ে, বাড়ে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ে, কিন্তু ফলন আশানুরূপ হয় না।
গ্রামাঞ্চলে অনেক সময় দেখা যায়, জমির পাশে বা ফসলি জমির মধ্যেই ফেলা হচ্ছে বাজারের পলিথিন বর্জ্য। বর্ষাকালে সেগুলো পানির সঙ্গে ভেসে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে, আবার শুষ্ক মৌসুমে চাষের সময় মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে জমে ওঠা এই পলিথিন একসময় কৃষিজমিকে কার্যত অকার্যকর করে তোলে। কৃষক তখন সমস্যার কারণ বুঝতে না পেরে শুধু ফলন কমার অভিযোগই করেন।
মাটি আমাদের খাদ্যের মূল উৎস, সভ্যতার ভিত্তি। সেই মাটিই যদি পলিথিনে বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তবে এর দায় এড়ানোর সুযোগ কারও নেই। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রেখে যাবো এমন এক কৃষিভূমি—যেখানে মাটি থাকবে, কিন্তু উর্বরতা থাকবে না। এ সংকট নীরব, কিন্তু এর পরিণতি হবে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী।
দেশে পলিথিনের বিস্তার কেবল কোনো একটি শ্রেণি বা খাতে সীমাবদ্ধ নয়। কাঁচাবাজারে গেলে দেখা যায়, প্রায় সব পণ্যই পলিথিনে মোড়ানো। মাছ, মাংস, শাকসবজি—সবকিছুর জন্য পলিথিন যেন একমাত্র ভরসা। বিক্রেতারা বলছেন, এটি সস্তা, সহজলভ্য এবং বিকল্পের তুলনায় সুবিধাজনক। অন্যদিকে সুপারশপে তুলনামূলকভাবে কিছু ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেলেও সেখানেও পুরোপুরি পলিথিনমুক্ত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত—সব স্তরের ভোক্তার জীবনেই পলিথিন কোনো না কোনোভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে—সরকারি নিষেধাজ্ঞা তাহলে কোথায়? পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পলিথিন নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিলেও কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা—পরিবেশদূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ পলিথিনে এখনও সয়লাব চারদিক। আইন আছে, ঘোষণা আছে, কিন্তু প্রয়োগের ঘাটতি স্পষ্ট।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর? কেন আইন প্রয়োগ করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না পলিথিনের অবাধ ব্যবহার? পরিবেশবিদরা বলছেন, সমস্যার মূল রয়েছে সমন্বয়ের অভাবে। আইন থাকলেও নিয়মিত তদারকি নেই, শাস্তি প্রয়োগে ধারাবাহিকতা নেই। কোথাও হঠাৎ অভিযান হয়, জরিমানা আদায় করা হয়, তারপর আবার সব আগের মতোই চলতে থাকে। ফলে আইনভঙ্গকারীদের মধ্যে ভয় বা সচেতনতা—কোনোটিই স্থায়ী হয় না।
পরিবেশবিদদের মতে, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীব্যাপী আন্দোলন চলছে। অনেক দেশ সফলভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ বা সীমিত করেছে। সেখানে সরকারের কঠোর নীতির পাশাপাশি জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশেও সেই পথেই হাঁটতে হবে। প্রয়োজনে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, মজুত ও বিক্রির ক্ষেত্রে আরও কঠোর আইন ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বিকল্প উপকরণ—যেমন কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ বা পরিবেশবান্ধব বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেট—সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে হবে।
শুধু আইন করলেই চলবে না, প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্রের পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারাবাহিক প্রচার চালাতে হবে। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকেই পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তুলতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পলিথিন নয়, প্রকৃতিকে বেছে নেয়।
নিষিদ্ধ পলিথিনের দাপট আসলে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি—নীতিনির্ধারক, প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—সবাই এর দায় এড়াতে পারে না। প্রশ্ন এখন আর শুধু ‘রুখবে কে’ নয়, বরং ‘আমরা কি সবাই মিলে রুখতে প্রস্তুত?’ যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তবে পলিথিনমুক্ত পরিবেশ আর কেবল স্লোগান থাকবে না—তা হয়ে উঠবে বাস্তবতা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট





