২০১৮ সালের ওসিদের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

এবার রাতের ভোটের ৬৩৯ ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

Any Akter
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৮:২৯ অপরাহ্ন, ০২ মার্চ ২০২৫ | আপডেট: ১২:০৬ অপরাহ্ন, ০৩ মার্চ ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত

২০১৮ সালের বহুল আলোচিত রাতের ভোটের দায়িত্ব পালন করা ডিসি ও এসপিদের পর এবার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে  দেশের আটটি রেঞ্জ ও মেট্রো পুলিশের ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করা ওসিদের তালিকা এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে যে কোন সময় বিভিন্ন শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্রে জানা গেছে আওয়ামী লীগ শাসনামলের বিতর্কিত তিন নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সকল মহলের। তিনটি নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ সংগঠিত হয়েছে ২০১৮ সালের বহুল আলোচিত রাতের ভোটের। দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ডিসি এসপি ইউ এন ও এবং ওসি দের সরাসরি নেতৃত্বে নির্বাচনের আগের রাতেই অর্ধেকের বেশি ব্যালটের সিল মেরে নির্বাচনী প্রহসন করা হয়।

ভোট গ্রহণের তিনদিন আগ থেকে বিরোধীদলীয় কর্মী সমর্থক ও প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা করতে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দেশের রাজনৈতিক মহলে এ নির্বাচনকে নিশি রাতের বুট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

এ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর ওএসডি করা সহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের অবৈধ উপার্জিত সম্পদের অনুসন্ধান এবং তাদের দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

একই কায়দায় এবার নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেব বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে দেশের আটটি রেঞ্জের ৬৪ টি জেলার ৫২৯ টি থানায় দায়িত্ব পালন করা ওসিদের নাম ও বর্তমান পদবী কর্মস্থলে বিবরণ পাঠানো হয়েছে।

তৎকালীন ৬ টি মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়িত্ব পালন করা ১১০টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায় একই সাথে তাদের বিদেশ যাত্রার বিষয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়  ওসির দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। অনেকেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার অনেকের পদোন্নতি মন্ত্রণালয় আটকে আছে। প্রায় তিন শতাধিক কর্মকর্তা এখনো ওসি ও সমমর্যাদার পদে কর্মরত আছে।

৫ আগস্টের পরও তাদের অনেকেই এখনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছে। তাদের বিষয়ে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সূত্র জানায় অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী। তারা নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় পূজি বিনিয়োগ করেছেন। বিশেষ করে ঢাকার বড় বড় ভূমিদস্যদের প্রতিষ্ঠানে বেনামে বিনিয়োগ রয়েছে।

এছাড়া পরিবহন ও গাড়ির ব্যবসা বিনিয়োগ করেছে শৈশব পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকা ধরে তাদের বর্তমান কার্যক্রম নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সম্পদের। সূত্র জানায় ২০১৮ সালে  থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। বৃহত্তর ফরিদপুর খুলনা ও গোপালগঞ্জ এলাকার সাবেক ছাত্রলীগের চিহ্নিত  ও আত্মশীকৃত আওয়ামী লীগপন্ত্রী কর্মকর্তারা এর নেতৃত্ব দেন।

এমনকি নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকেই যাচাই-বাছাই করে সারাদেশেই গুরুত্বপূর্ণত্থানাগুলিতে তাদের পদায়ন করা হয়। প্রয়োজন মোতাবেক নির্বাচনের তিনদিন আগেও ওসি পরিবর্তন করে নিয়োগ দেয়া হয়। আলোচনায় ওসিদের বিষয়টা এসেছে রাতের ভোটে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন নিয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় নির্বাচনের সকল রাজনৈতিক দল অংশ নেয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য সূক্ষ্মক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন।

সেই মোতাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচডি ইমামের তত্ত্বাবধানে পুলিশ সেড কোয়ার্টারে ডিআইজি প্রশাসন হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারা সারাদেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে একটি নির্বাচনী আগাম ফলাফল তৈরি করেছিল।

তাতে সারাদেশে নির্বাচনী ভোটকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। তন্মধ্যে পুলিশের জরিপ অনুযায়ী ১শ  আসনে নিশ্চিতভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হবে বলে একে সবুজ তালিকা ভুক্ত করেছিল। আবার ১০০ আসনে বিএনপি নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য ফন্টের প্রার্থীরা বিজয়ী হবে বলে রেড তালিকাভুক্ত করেছিল।

আবার ১৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ নির্বাচন হবে বলে হলুদ রঙের তালিকা করেছিল। উপদেষ্টা এইচডি ইমামের নির্দেশনা মোতাবেক হলুদ রঙের তালিকা ধরে নৌকার প্রার্থীদের আগাম কিছু ভোট মেরে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সেই মোতাবেক তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর সাথে পরামর্শ করে হাবিবুর রহমানের নির্দেশে সরাসরি এসপি ওসিদেরকে আগাম ভোট মারার নির্দেশনা দেন।

এভাবে একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও জনপ্রসন মন্ত্রণালয় থেকে ডিসি ও ইউএননোদের আগাম বুট পারা নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় নির্বাচনের আগের রাতে প্রত্যেক থানায় ওসিদের কাছে দেন দরবার চলে মন্ত্রী এমপিদের। 

নগদ টাকার বস্তা ও মন্ত্রী এমপিদের তদবিরের মুখে  অতি উৎসাহী হয়ে আগের রাতে ফিফটি পার্সেন্ট এর উপরে ব্যালট সিল মেরে ব্যালট বক্স ভর্তি করে রাখে। কার নেতৃত্বে আগের রাতে নৌকায় সিল মারবে এ নিয়ে ওসি ইউএন ও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার দের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায় নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং চোখ মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিরোধী দলীয় কিছু প্রার্থীকে বিজয়ী করার নির্দেশনা দিলেও ওসিদের রাতের ভোটের প্রতি উৎসাহের মুখে কেন্দ্রের কোন নির্দেশেই পালিত হয়নি। ভোটগ্রহণ গ্রহন শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠদের নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চাইলে দেখে ভোট সব আগাম হয়ে গেছে। এতে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের সমস্ত বাজেট পরবর্তীতে আটকে দেন।

অনুসন্ধানের জানাজায় প্রত্যেক জেলা ও বিভাগে গণফোরাম বিএনপি ও শরিক দলের কিছু প্রার্থীকে বিজয়ী করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। আর কিছু প্রার্থীকে যেভাবেই হোক পরাজিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত বলা হয়েছিল অধ্যাপক আবু সাঈদ ও মাহমুদুর রহমান মান্না যাতে কোনভাবেই বিজয়ী না হয়।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক বিরোধী দলীয় কোন প্রার্থীকে বিজয়ী করার ঝুঁকি নেয়নি পুলিশ সুপাররা। বিশেষ করে মোস্তফা মহসিন মন্টু কাদের সিদ্দিকী, ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন, উকিল আব্দুস সাত্তার, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আসনে বিএনপির নজরুল ইসলামকে বিজয়ী করার কঠোর নির্দেশনা ছিল।

দাউদকান্দি আসনে ডঃ খন্দকার মোশাররফকে বিজয়ী করতে একজন নতুন পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ করে সুষ্ঠ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পার্শবর্তী মেঘনা থানার ওসির নেতৃত্বে আগের রাতে শতভাগ ভোট মেরে ম্যাকানিজম পাল্টে দেওয়া হয়। অন্যান্য আসনেও ওসিরা এমপি মন্ত্রীদের নিকট থেকে বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে উপরের নির্দেশনা জোরপূর্বক পাল্টে দেন।

তৎকালীন সময়ে আলোচনায় এসেছে নির্বাচনে ওসিদের ক্ষমতা। এমনকি পরবর্তী সময়ে অনেক ওসিকে বলতে শোনা যায় আওয়ামী লীগকে আমরাই ক্ষমতায় এনেছি। অনেক ওসিকে সুনির্দিষ্ট করে বলতে শোনা যায় অমুককে আমি এমপি বানিয়েছি, অমুককে মন্ত্রী বানিয়েছে। এজন্য ওসিদের কাছে এমপি মন্ত্রীরা ছিল অনেকটা অসহায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায় ১৮ সালের রাতের ভোটের দায়িত্ব পালন করা ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে সাক্ষাৎ করেছে।

এরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ সেফ্ট করার ১৮ সালের দায়িত্ব পালন করা ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে একসাথে কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

বিষয়টি এখন স্বরাষ্ট্র সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শাস্তির ধরন বদলি ও এস ডি, বাধ্যতামূলক অবসর সহ বিভিন্ন বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। তাদের অনেকেই পলাতক। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন নেতাদের তালিকা ধরে ও পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন ডিআইজি হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজনদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।