ন্যায় বিচারের পথে একধাপ এগুলো বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ দাখিলে এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গুমের ঘটনায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, এ উদ্যোগ দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) এক সংবাদ প্রতিবেদনে এ সন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি।
আরও পড়ুন: বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত: ট্রাইব্যুনালের অভিমত
এইচআরডব্লিউ অবশ্য এ-ও বলেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখনও ঘটছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো রয়েই গেছে।এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলির লেখা প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—‘ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনের শুরুতে ২০১৭ সালে এইচআরডব্লিউ প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়।
বাংলাদেশে গোপনে আটক রাখা ও গুম করা নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ বলেছে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সেই প্রতিবেদনকে ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তারা গ্রেপ্তারের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী, ঋণখেলাপি কিংবা প্রতারক।
আরও পড়ুন: রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ওই সময় তার জোর দাবির কারণে আসাদুজ্জামান তদন্তের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা আরও শক্তিশালী হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আসাদুজ্জামান খান। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বাক্স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ সম্পর্কে এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় সরকার সাধারণত সেগুলো অস্বীকার করত বা মিথ্যা আশ্বাস দিত।
২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এসব দমনপীড়ন অব্যাহত থেকেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা তিন সপ্তাহ তীব্র বিক্ষোভের পর হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারান। হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের উদ্যোগে একটি গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেখানে কমপক্ষে ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ জমা পড়ে।
তদন্তে দেখা যায়, তিন শতাধিক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে নৃশংসতার ভয়াবহ বর্ণনাসহ কমিশনের অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনকালে গুমের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দুটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর গতকাল বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খানসহ সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা মিলিয়ে ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতে অভিযোগগুলো ঘোষণা করার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমানও ছিলেন। যেসব ব্যক্তি গুম ও গোপনে আটকে রাখা ঘটনাগুলো এইচআরডব্লিউ নথিভুক্ত করেছিলেন, তাদেরই একজন তিনি। ২০১৬ সালে নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি একটি চিঠিতে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকার কথা জানিয়েছিলেন। পরে তাকে একটি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন বন্দীশালায় আট বছর আটকে রাখা হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পরই তিনি মুক্তি পান।
প্রতিবেদনে মীনাক্ষী জানান, ২০১৬ সালে নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে মীর আহমেদ বিন কাসেম তাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ‘শঙ্কিত’ থাকার কথা জানিয়েছিলেন। তাকে একটি গোপন সামরিক গোয়েন্দা আটক কেন্দ্রে আট বছর ধরে আটক রাখা হয়েছিল এবং হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।
প্রতিবেদনের একেবারে শেষে এসে মীনাক্ষী লিখেছেন, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমরাও এমন অলৌকিক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করি। তবুও প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করা হবে। তবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো এখনো থেকে গেছে।