দুদকের অনুসন্ধান, ধামাচাপায় প্রভাবশালীদের তদবির
চেয়ারম্যান এমডিসহ পূবালী ব্যাংক পরিচালকদের ভয়াবহ দুর্নীতি চিত্র

ডলার কারসাজি, ঋণজালিয়াতি ও অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এমডিসহ কয়েক পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান চলছে। তবে ব্যাংকটির প্রভাবশালী একটি মহল ওই অনুসন্ধান ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধান তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনুসন্ধান করছেন না।
জানা গেছে, পূবালী ব্যাংকে ফ্যাসিবাদের বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, ঋণখেলাপি পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব, ফাহিম আহমদ ফারুক চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান শুরু হয়। কমিশনের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নোটিশও করেছেন দুদক।
আরও পড়ুন: প্রথম ১০ দিনে অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল করলেন ৯৬ হাজারের বেশি করদাতা
অভিযোগের বিবরণ থেকে জানা গেছে, পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব মনঞ্জুরুর রহমান, হাফিজ আহমদ মজুমদার ও পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে তাদের অনুকূলে নেয়। যাদের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন নিয়ম বহির্ভূত কাজ চালিয়ে আসছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক খুরশিদ-উল-আলমকে হাত করে ব্যাংকটির যাবতীয় অবৈধ কার্যকলাপ পরিচালিত হতো। বিনিময়ে খুরশিদ-উল-আলমকে পূবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন ব্যাংকটির ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডাইরেক্টরছিলেন। অপর স্বতন্ত্র পরিচালক নওশাদ আলী চৌধুরীও পূর্বসূরির মতোই আজ্ঞাবহ হয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মনঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া পূবালী ব্যাংকের পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব দীর্ঘদিন যাবত উক্ত ব্যাংকেরই একজন বড় ঋণ খেলাপি। বর্তমানে তার চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে ঋণ প্রায় ১৩২ কোটি টাকারও বেশি। চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় হাফিজ আহমদ মজুমদার ঋণের সুদ মওকুফ করে ৬৫ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন, কিন্তু উক্ত টাকাও পরিশোধ করতে কবিরুজ্জামান ইয়াকুব ব্যর্থ হয়। এতো সাহায্য সহযোগিতা করার পরও উক্ত চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও অদৃশ্য ক্ষমতা বলে তিনি পরিচালক পদে আছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও কোন রহস্যজনক কারণে কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ।
এছাড়া আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও স্বতন্ত্র এমপি ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এ.কে আজাদ সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ মজুমদারের একজন ঘনিষ্ঠ। তিনি হাফিজ মজুমদার সাহেবের গার্মেন্টসে বিভিন্ন সাহায্য করে আসছেন। বিনিময়ে তাকে পূবালী ব্যাংকের শেয়ার কিনতে সাহায্য করে পূবালী ব্যাংকের প্রায় ১১ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করান তার গার্মেন্টসের নামে। হাফিজ মজুমদার নিজ উদ্যোগে এ.কে আজাদের একজন প্রতিনিধি জনাব আব্দুর রাজ্জাক মন্ডলকে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক করেছেন। মনঞ্জুরুর রহমান, হাফিজ আহমদ মজুমদার ও এ.কে আজাদ পূবালী ব্যাংকের শেয়ার কিনে তারা এস.আলম গ্রুপের মত এই ব্যাংকটিকে কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা করেছেন।
আরও পড়ুন: পাম অয়েলের দাম লিটারে কমলো ১৯ টাকা
অভিযোগ থেকে আরও জানা গেছে, ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে সরকারের বিভিন্ন মহলকে হাত করে মঞ্জুরুর রহমান ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তার সহায়ক দুর্নীতিবাজ কয়েকজন পরিচালকদের নিয়ে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্নীতি করেন। যার পরিণতিতে ব্যাংকটির বর্তমানে করুণ ও ভয়ানক চিত্র ফুটে উঠেছে। মঞ্জুরুর রহমান পূবালী ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে সরে আসার পর সেখানে হাফিজ আহমদ মজুমদারকে চেয়ারম্যান বানান এবং এ.কে আজাদের ছেলেকে পরিচালক পদে বসিয়েছেন। এছাড়া হাফিজ আহমদ মজুমদার ও মঞ্জুরুর রহমান যাকে ইচ্ছা পূবালী ব্যাংকের চাকরি দিয়েছেন; এক্ষেত্রে কোন রকম যোগ্যতার বাছবিচার ছাড়াই। ব্যাংকে কে থাকবে আর কে থাকবেনা সেটা তারা নিজেরা ইচ্ছেমতো নির্বাচন করেন।
প্রতিটি বার্ষিক সাধারণ সভার আগে প্রক্সি ভোট ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা হাফিজ আহমদ মজুমদারের নিকট জমা দেওয়ার একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি হাফিজ মজুমদার ও মঞ্জুরুর রহমান চালু করেন। এর আসল কারণ হলো যাতে তারা তাদের নিজস্ব পছন্দের লোকদের বোর্ডের পরিচালক বানিয়ে আজ্ঞাবহ করে রাখতে পারেন। অথচ তারা ব্যাংক থেকে বিএনপির সাবেক এমপি শফি উদ্দিন চৌধুরী ও তার ভাই সাব্কে আইজিপি ই-এ চৌধুরীকে পরিচালক থেকে সরিয়ে দেয়। কারন তারা বোর্ডে উপস্থিত থাকলে অসাধু চক্রের দুর্নীতি বাঁধাগ্রস্ত হতে থাকে। এই ভাবেই এক পর্যায়ে তারা অএগ এর ভোট কুক্ষিগত করে শফি উদ্দিন চৌধুরীকে বোর্ডে থাকতে দেয়নি।
অভিযোগের বিবরণমতে পূবালী ব্যাংক ১৯৮৬ সালে ব্যক্তি মালিকানায় আসার পর পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কারণে ব্যাংকটি খুব অল্প সময়ে মধ্যেই একটি সফল ব্যাংকে পরিণত হয়। এরপরই ব্যাংক খেকো দুর্নীতিবাজদের কুদৃষ্টি পড়ে পূবালী ব্যাংকের ওপর। নামে বেনামে ব্যাংকের সিএসআর এম ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। চন্দ্রা স্পিনিং মিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাই না করে কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। যার ফলে পূবালী ব্যাংকে ঋণ খেলাপির সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো কমতে থাকে। দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেট চক্রের অন্যতম হোতা হাফিজ আহমেদ মজুমদার বিগত আওয়ামী সরকারের দোসর থেকেও অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে ব্যাংকে খবরদারি করে যাচ্ছেন এবং তার সাথে আছেন এ.কে আজাদ ও বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান। দুদকের অভিযোগে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের মাধ্যমে লোন দেওয়ার বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। কয়েকটি দপ্তরে ও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠি দিয়ে বক্তব্য চাওয়া হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি।
অভিযোগের বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী বলেন, দুদক অনুসন্ধান করছে। তাদের চাহিত তথ্য দেয়া হচ্ছে। দেখা যাক তারা কি প্রতিবেদন দেয়। পূবালী ব্যাংকের অনুসন্ধান ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেন মোহাম্মদ আলী।