রিমান্ডে সালমান ও আনিসুলকে ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ
দশ দিনের রিমান্ডে ডিবি হেফাজতে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
ছাত্রদের কোটা আন্দোলন শুরুর পর থেকে বিশেষ করে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণহত্যা, ছাত্র আন্দোলনে কাদের নির্দেশে গুলি করা হয়েছে এবিষয়ে জেরা করা হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। নিউমার্কেট থানায় হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় তারা ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল তাদের রিমান্ডের প্রথম দিন। রিমান্ডের প্রথম দিনে তাদেরকে জিজ্ঞাবাদের জন্য ডিবির চৌকস সদস্যদের নেতৃত্বে বিশেষ একটি টিম গঠন করা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। নিউমার্কেট থানার হত্যা মামলা ছাড়াও সালমান এফ রহমানকে শেয়ার বাজার কেলেঙ্করি ও এত দিন কোথায় আত্মগোপনে ছিলেন, তাদের কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ডিএমপির কমিশনার মাইনুল হাসান জানান গোয়েন্দা হেফাজতে নেওয়া আসামিদের গণহত্যার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও জড়িতদের চিহ্নিত করতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করে মামলার অভিযোগপত্র তৈরি করা হবে। প্রয়োজনীয় অগ্রগতি জানানো হবে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পাটভিত্তিক উৎপাদনে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী চীন
ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে ডিবিতে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন তাদেরকে অনেকেই ৫ আগস্টের পর বদলী করা হয়েছে। অনেকে অজানা আতঙ্কে অফিস করেননি। তবে ইতোমধ্যে কর্মকর্তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। যাদের বদলী করা হয়েছে তারাও কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বাছাই করা কর্মকর্তাদের দিয়ে সালমান ও আনিসুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ছাত্র আন্দোলন দমনে বিদেশি কারও ইন্ধন ছিল কিনা, পুলিশকে কারা গুলির নির্দেশ দিয়েছে এসব বিষয়ে জেরা করা হয়। আনিসুল হককে আইন মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যহার ও দুর্নীতির বিষয়েও জেরা করা হয়েছে। আর সালমান এফ রহমানকে শেয়ার বাজার কেলেঙ্করী, অর্থ পাচারসহ নানা বিসয়ে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে।
এবিষয়ে ডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রথম দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তাদেরকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের কাছ থেকে কি পাওয়া গেলো এবিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের জানানো হবে।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে সাংবাদিকদের বেরিয়ে আসার আহ্বান মির্জা ফখরুলের
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সদরঘাট দিয়ে নৌকা যোগে পালায়ন করার সময় সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে কোস্ট গার্ডের সহায়তায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের লুঙ্গি পরা ও হাতবাঁধা ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরদিনে নিউমার্কেট থানায় হকার শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে তোলার সময় আইনজীবিরা বিক্ষোভ করেন তাদের লক্ষ্য করে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করেন। আদালতে আসামী পক্ষের কোন আইনজীবী ছিলেন না। আদালতে থেকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে তাদেরকে সাধারণ বন্দীর মতোই রাখা হয়েছে।
মামলার বাদী আদালতে বলেন, গত ১৬ জুলাই সকালে বাদীর ছেলে দোকানে আসে। অজ্ঞাতনামা আসামিরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তার রেলিং ভাঙচুর করতে করতে নিউ মার্কেটের দিকে যায়। তারা রাস্তায় থাকা বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেয়। এ সময় ওপরে উল্লিখিত আসামিদের হুকুমে এবং ইন্ধনে অজ্ঞাতনামা আসামিরা শাহজাহান আলীর মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এক পর্যায়ে অজ্ঞাতনামা আসামি বাদীর ছেলেকে গুলি করে। এতে ভিকটিম রাস্তায় পড়ে থাকলে উপস্থিত পথচারীরা ভিকটিম শাজাহানকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ধানমন্ডি পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে শাহজাহানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরে পপুলার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহজাহানকে পরীক্ষা করে ১৬ জুলাই মৃত ঘোষণা করেন।
শাহজাহান আলীর বাবা ইমাম হোসেন নিজেই কথা বলেন। আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত আমারও কিছু কথা আছে। আমি তাদের ফাঁসি চাই। এরা আমার ছেলের লাশ পর্যন্ত দেখতে দেয়নি। আমার ছেলেকে দাফনও দিতে পারিনি। এরা খুনি।’ শুনানি শেষে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে, পলাতক অবস্থায় আনিসুল হকের কাছ থেকে তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে ১৭ হাজার ৫১২ ইউএস ডলার, ৭২৬ সিঙ্গাপুর ডলার। এর বাইরে তিনটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল) পাওয়া যায়। এছাড়া সালমান এফ রহমানের কাছ থেকে ১২ হাজার ৬২৮ ইউএস ডলার, ৬২০ ফ্রাঁ, ৬ হাজার ৫০০ দিরহাম, উজবেকিস্তানের ১৩ লাখ মুদ্রা, ১৯ হাজার ৬৫০ রিয়াল, ৭৭৯ সিঙ্গাপুরি ডলার, ১৫০ পাউন্ড, ১ হাজার ৩২১ ইউরো, ভুটানের মুদ্রা ৬ হাজার ২৩০ রুপি, ৩ হাজার ২২০ থাই বাথ, বাংলাদেশি ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে সালমানের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা ছাড়াও পাওয়া যায় একটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ও একটি স্যাটেলাইট ফোন। এসব বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করা হবে জানা গেছে।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা জানি সালমান এফ রহমান শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি এবং কারসাজির হোতা। ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল না। কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারের কারণে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দেয় পুলিশের অপরাধ বিভাগ সিআইডি। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে তাকে কিছু জেরা করা হয়েছে।





