ভূমি জরিপ অধিদপ্তরে ‘চলতি দায়িত্বে’ চরম অনিয়ম: ১০৩ শূন্য পদের বিপরীতে ৪৫৫ জন নিয়োগ

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ‘উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার’ পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানে চরম অনিয়ম হওয়ায় অধিদপ্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ১৫ অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ অধিশাখা-১ এর উপসচিব এম এম জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত ৩১৬ নম্বর প্রজ্ঞাপনে ২৫২ জন সেটেলমেন্ট বিভাগের সার্ভেয়ার, ড্রাফটস্ম্যান কাম এরিয়া এস্টিমেটর কাম সিট কিপার ৭৩ জন এবং ননটেকনিক্যাল কারনিক পদের (যারা সাধারণ এসএসসি/এইচএসসি পাশ যোগ্যতায় চাকুরী নিয়ে) রেকর্ড কিপার, খারিজ সহকারী ও কপিষ্ট কাম বেঞ্চ সহকারী পদ থেকে ১৩০ জনসহ মোট ৪৫৫ জনকে ‘উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার’ পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরই সাথে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ১৯৫৫ বিধিমালার ২৬,২৭, ও ২৮ বিধির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে রেকর্ড কিপার, খারিজ সহকারী ও কপিষ্ট কাম বেঞ্চ সহকারী সাধারণ কেরানীক শ্রেণীর কর্মচারী যাদের সার্ভে বিষয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই তাদের ও ট্রাভার্স-কিস্তোয়ার-খানাপুরি-বুজারত-তসদিক(সত্যায়িত) এর কাজের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনা বিরল হওয়ায় সাধারণ জনগণের নকশা ও রেকর্ড নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের জরিপ অধিশাখা-১ এর অসাধু কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: ‘জুলাই সনদ’-এর প্রশংসা কানাডার, গণতান্ত্রিক উত্তরণে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার
জানা যায়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধিতে ফিডারপদ (পদোন্নতির যোগ্য পদ) সাবসার্ভেয়ার, কম্পিউটর, ড্রাফটস্ম্যান ও বাউন্ডারি আমীনরা অর্ন্তভূক্ত ছিল অথচ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উল্লেখিত কর্মকর্তারা সুকৌশলে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ফিডারপদধারী ৪ বছর ডিপ্লোমা পাশ করা সাবসার্ভেয়ার, কম্পিউটর, ড্রাফটস্ম্যান ও বাউন্ডারি আমীনদের গত ২০২৩ সালের নিয়োগবিধিতে ‘উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার’ পদে পদোন্নতির বাইরে রেখে নিয়োগবিধি করতে গেলে উল্লেখিত ৪ পদের কর্মচারীরা মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করলে (মামলা নং-১৬৭৮৫/২০২৩) গত ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্ট আবেদনকারী ৪ পদের ৩৩ জনের জন্য ৩৩টি পদ সংরক্ষণ/শুণ্য রেখে বাকীদের পদোন্নতির আদেশ দেন। কিন্তু পদোন্নতিতে হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করে গত ১৫ অক্টোবরের ৩১৬ নম্বর প্রজ্ঞাপনে ৪৫৫ জনের ‘উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার’ পদে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: পাসপোর্ট ফি সবার জন্য সমান থাকবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, অধিদপ্তরের মোট ৬১৮টি উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের পদ আছে যার মধ্যে ৫০% সরাসরি নিয়োগ বাকী ৫০% পদোন্নতি নিয়োগবিধি অনুসারে পাবেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে গত ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর ২৭৮ জনের সরাসরি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে নিয়োগ চলমান রয়েছে। কর্মরত ২০৬ জন পদোন্নতি পেয়ে এসেছেন, সে মতে ১০৩ জনকে পদোন্নতি দেয়া যায়, কিন্তু ৪৫৫ জনকে কিভাবে পদোন্নতি দেয়া হলো এ নিয়ে অধিদপ্তর তোলপাড় শুরু হয়।
‘চলতি দায়িত্ব’ নীতিমালা-২০২৩-এর প্রজ্ঞাপনের দ্বিতীয় লাইনে সুস্পষ্ট লেখা আছে ‘শূণ্য পদে’ চলতি দায়িত্ব প্রদান করা কিন্তু ১০৩ পদের বিপরীতে ৪৫৫ জনের কত কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে তা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। এই নীতিমালার ধারা ৬(১) ও ধারা ৭ অনুযায়ী চলতি দায়িত্ব শুধুমাত্র পরবর্তী উচ্চতর পদে/ফিডার পদে এবং শূন্য পদের সংখ্যার অনধিক কর্মচারীকে প্রদান করতে হবে। ১০৩টি শূন্য পদের বিপরীতে ৪৫৫ জনকে চলতি দায়িত্ব দেয়া শূন্য পদের সংখ্যা অতিক্রম করার চরম অনিয়ম। যা সরকারের প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অপচয় ছাড়া কিছু নয়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (নিয়োগ) বিধিমালা-২০১৪ এর লঙ্ঘন-এ আইনের ধারা ৩০(২) - অনুযায়ী শূণ্য পদে অস্থায়ী দায়িত্ব শুধুমাত্র একই ধরণের দায়িত্ব পালনে সক্ষম নিকটস্থ নিম্নতর পদস্থ কর্মচারীকে দেয়া যাবে। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় ১৪/১৫/১৬তম গ্রেড থেকে ১০ গ্রেডে সরাসরি চলতি দায়িত্ব ‘নিকটস্থ’-এর সংজ্ঞার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরও জানা যায়, এতে করে বাংলাদেশ সেটেলমেন্ট রেকর্ডস ম্যানুয়াল এবং ভূমি রাজস্ব বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার পদটি একটি টেকনিক্যাল ও কোয়াসি-জুডিশিয়াল পদ। এই পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিই
কেবল: ২৬,২৭,২৮ বিধিতে শুনানি ও নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন ও রাজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন এবং খতিয়ান প্রস্তুতকরণ ও জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু ১৪,১৫,১৬তম গ্রেডের কমর্চারীরা রেভিনিউ ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ সেটেলমেন্ট রেকর্ডস ম্যানুয়াল এবং ভূমি রাজস্ব বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক ন্যায়বিচার (Natural Justice) নীতির লঙ্ঘন-
মামলা: কেএম হাবিবুর রহমান বনাম বাংলাদেশ (২০১৬) এবং সেকেন্দার আলী বনাম বাংলাদেশ (২০১৮) সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান: চলতি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদেরকে চূড়ান্ত ও বিচারিক ক্ষমতা প্রদান প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ২ এর ২৪ ধারায় আইন হচ্ছে ‘কর্মকর্তারা’ রেভিনিউ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবেন কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের গত ১৫ অক্টোবরের ৩১৬ নম্বর প্রজ্ঞাপনে ১৪,১৫,১৬ গ্রেডের কর্মচারীদের রেভিনিউ ক্ষমতা প্রদানে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ ভূলন্ঠিত করা হয়েছে। ৪৫৫ জনের প্রজ্ঞাপনে হাইকোর্টে ১৬৭৮৫/২০২৩ নম্বর রিট মামলায় গত ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদেশকে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে ভূমি রেকর্ড ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ অধিশাখার-১ দূর্ণীতি পরায়ন অসাধু কর্মকর্তারা।
তেজগাওঁস্থ ভূমি ভবনের অধিদপ্তর থেকে আরো জানা যায়, ৪৫৫ জনের চলতি দায়িত্ব পদোন্নতির প্রস্তাব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন এবং প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষরকারী ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ অধিশাখা-১-এর উপসচিব এম এম জাহাঙ্গীর হোসেন বাকী বাণিজ্য করেছেন। অনেক কমর্চারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেছেন, কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য ৪৫৫ জনের প্রতি জনের কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা করে তুলেছেন পদোন্নতিপ্রাপ্ত সমিতির নেতারা। বিগত ২০০৩ সাল থেকে শতাধিক মামলায় পরাজিত ১৬ গ্রেডের কারণিক শ্রেণীর রেকর্ড কিপার, খারিজ সহকারী ও কপিষ্ট কাম বেঞ্চ সহকারী যারা সেটেলমেন্টের ডিজিটাল জরিপের নকশা তৈরির কোন অক্ষরজ্ঞানবিহীন কর্মচারীদের দিয়ে ডিজিটাল জরিপ পরিচালনা করা মানে অধিদপ্তরের ডিজি ও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের গলায় ফাঁসির দড়ি দেয়ার সমান বলে জানান তারা।