সচিব ও এডিজির সিন্ডিকেট হয়রানিতে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা

প্রবাসী ভবন ও বিএমইটি ফ্যাসিস্ট মাফিয়া ব্যবসায়ী পুনর্বাসনের আখড়া

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:৫৭ অপরাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১১:০৪ অপরাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের অন্যতম উৎস বৈদেশিক রেমিট্যান্স। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও প্রবাসী ভবন ও বিএমইটির প্রভাবশালী সিন্ডিকেটে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধা বিদেশগামী শ্রমিকরা। বিদেশগামী শ্রমিকরা পদে পদে প্রতারণা, হয়রানি ও ঘুষ–দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।

বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে বেপরোয়া আদম ব্যবসায়ী মাফিয়া সিন্ডিকেট প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে আগের চেয়ে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে এই বাণিজ্যে। ফলে শ্রমিকরা হয়রানির পাশাপাশি বাজার হারাতে বসেছে বিভিন্ন দেশে। মালয়েশিয়া, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন বাজার তৈরিতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর সরকারি দায়িত্ব পালন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শ্রম কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকার পালিয়ে গেলেও এই দপ্তরে সরকারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বৈরাচারী সরকারের অনুসারী মাফিয়া আদম বেপারীরাই এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে এই দুটি অফিস।

অভিযোগে জানা যায়, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু রেখেই প্রতি কর্মীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত আদায় করে অপ্রচলিত দেশ যেমন রাশিয়া, কঙ্গো, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ইরাক, কুয়েত, জাপান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এককভাবে লোক পাঠানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন: এবার জনগণই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে: সালাহউদ্দিন আহমদ

ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় গড়ে ওঠা চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রবাসী ভবন ও ব্যুরো অফিস পরিচালিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চিহ্নিত বিতর্কিত এই চারটি এজেন্সির বিরুদ্ধেই মানব পাচার আইন, মানি লন্ডারিংসহ নানা মামলার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে।

অভিযোগে জানা যায়, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কথিত পিয়ন “পানি জাহাঙ্গীর”-এর সহায়তায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে চারটি কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে — নুরজাহানের টি-টোয়েন্টি ওভারসিজ, রাসেলের মালিকানাধীন দ্য ইফতি ওভারসিজ, খোরশেদ আলমের জেএসকে ওভারসিজ ও হামিদের মালিকানাধীন মাসুদ জামিল ওভারসিজ। বিগত ১৭ বছরে তারা চরম সুবিধাভোগী ছিল।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে যুক্ত সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত ১৭ বছরে উল্লিখিত চারটি এজেন্সি একচেটিয়াভাবে প্রভাব বিস্তার করে বাণিজ্য করেছে।

পাঁচ আগস্টের পর চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া সচিব নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে— তিনি ফ্যাসিস্ট আমলে সুবিধাভোগী আদম বেপারীদের পুনর্বাসনের সুযোগ দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়াকে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে ফোন কেটে দেন।

পৃথিবীর উন্নত গুরুত্বপূর্ণ দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিলেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও বাণিজ্য সিন্ডিকেটের কারণে সম্ভাবনাময় বাজার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবে ‘১ থেকে ১০০’ বাধ্যবাধকতার কারণে কর্মী পাঠানো জটিল হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের শ্রমরপ্তানি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের গঠনের শুরুতেই পুরনো মাফিয়াদের খপ্পরে বৈদেশিক শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় ব্যবসায়িক উদ্যোক্তারা হতাশ। নতুন ও নৈতিক ব্যবসায়ীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক নতুন উদ্যোক্তা রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসায়িক ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।

শ্রম জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ অফিস এবং প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও আগাম বাণিজ্যিক সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাজার তৈরির সম্ভাবনা দ্রুত হারাচ্ছে। নতুন শ্রমবাজারের খবরে পুরনো মাফিয়া সিন্ডিকেট অবৈধ কমিশনের লোভে আগাম ঝাঁপিয়ে পড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তাদের আগ্রাসী অফারের কারণে নৈতিক ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারছেন না।

এদিকে থাইল্যান্ড দূতাবাসের লেবার কাউন্সেলর ফাহাদ-এর বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি থাইল্যান্ড দূতাবাসের পাশাপাশি কম্বোডিয়ার দায়িত্বেও নিয়োজিত।

অভিযোগ রয়েছে, থাইল্যান্ড দূতাবাসের এই লেবার কাউন্সেলর ১৩ হাজার শ্রমিককে সত্যায়ন করিয়েছেন। প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে ৪ হাজার বাথ করে নিলেও এক টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা দেননি।

জনশক্তি রপ্তানিতে জড়িত প্রতিটি পর্যায়ে ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। প্রতি শ্রমিকের মাথাপিছু ঘুষ দিতে হয় রিক্রুটিং এজেন্সিকে। আবার রিক্রুটিং এজেন্সি এর তিনগুণ টাকা আদায় করে শ্রমিকের কাছ থেকে। রাজধানীর নয়াপল্টন, মতিঝিল, আরামবাগ, গুলশান ও বনানী এলাকার রিক্রুটিং অফিসগুলোতে শ্রমিকদের ভিড় ও হাহাকারের চিত্র প্রতিদিন দেখা যায়।