১৪ মাসে ৪০ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন

Sanchoy Biswas
বিবিসি রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৮:০৩ অপরাহ্ন, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৮:০৩ অপরাহ্ন, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

২১শে জুলাই ২০২৫। রাজধানীর মিরপুর থেকে ৩০ রাউন্ড গুলিসহ তিনজন যুবদল নেতাকে আটক করে যৌথবাহিনী, যাদের একজন আসিফ শিকদার।

আটককৃতদের প্রথমে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার সেনা ক্যাম্পে এবং পরে শাহ আলী থানায় নেওয়া হয়। এসময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক আসিফকে মৃত ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন: একইদিনে নির্বাচন ও গণভোটে ৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের চিন্তা

কেবল আসিফই নয়, ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর – অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত ১৪ মাসে দেশে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এসেছে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। নিহত ৪০ জনের মধ্যে ১৯ জনকে গুলি, ১৪ জনকে নির্যাতন এবং সাতজনকে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে: মির্জা ফখরুল

বিচারবহির্ভূতভাবে গুম-খুনের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। গণআন্দোলনের মুখে পতন হয় সেই সরকারের।

নতুন করে সরকার পরিচালনার জন্য শপথ নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই সেসময় হওয়া বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় তারা। বন্ধ করা যায়নি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, শুরু থেকেই সরকারের অবস্থান মৃয়মান থাকায় অনেকক্ষেত্রেই তারা শক্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আর সেকারণেই এই ধরনের ঘটনাগুলো চলমান রয়েছে।

তাদের মতে, আগের সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে নিজেদের প্রয়োজনে এগুলোকে ব্যবহার করতো। অন্যদিকে দুর্বলতার কারণে বর্তমান সরকার এই ঘটনাগুলো থামাতে পারছে না।

এনিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে তার তিনদিন পর আটই অগাস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

সরকারের দায়িত্ব নেওয়া বাকি পদগুলোর বেশিরভাগেই ছিল সাবেক শাসনামলে ঘটা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরব মুখগুলো। অনেকেই আশা করেছিলেন, গণআন্দোলনের পর গঠন হওয়া সরকারের হাত ধরেই আসবে নতুন পরিবর্তন।

কিন্তু তেমন কিছু দেখা যায়নি। একদিকে যেমন গণ-অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, অন্যদিকে অরাজনৈতিক সরকারের আমলেও চলমান রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

অধিকার-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অর্থাৎ গত তিন মাসেই ১১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, মোট হিসাব করলে মাসপ্রতি যার গড় সংখ্যা দাঁড়ায় তিন। একইসময়ে কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের।

এর আগে, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

জুলাইয়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও অতীতের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও অন্যায়ভাবে আটক করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টিও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।

এছাড়া ভিন্নমত দমনে আগের সরকারের মতো এখনও বিশেষ ক্ষমতা আইনে শত শত লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলেও দাবি করা হয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে।

যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে সরকার। প্রতিবেদনটিকে একপেশে দাবি করে সেসময় আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়ায় কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য আইনগত সংস্কারের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

এই মাসে প্রকাশিত সংস্থাটির আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নতুন করে দমন-পীড়ন করছে।


এখনও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাবের বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এই বাহিনী এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

জুলাই আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার পতন হলে নানা খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় পুলিশ সংস্কার কমিশন।

বলা হয়েছিল, রাজনৈতিকভাবে তাদের ব্যবহারের যে প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, তা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে মুক্ত করা হবে।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়। একইসাথে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবিকে সীমান্তরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরকে সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়।

তারপর প্রায় আট মাস কেটে গেলেও র‍্যাবসহ বাহিনীগুলোর ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পোশাক পরিবর্তনের আলাপ ছাড়া প্রত্যক্ষ কোনো সংস্কার দেখা যায়নি বাহিনীগুলোতেও। তবে নির্যাতন ও গুমবিরোধী কিছু আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে সরকার।

কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ধরণ অর্থাৎ যেভাবে তারা ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা নির্যাতনে লিপ্ত হতেন, সেই "সিস্টেম্যাটিক জায়গায় অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের সংস্কার করতে পারেননি" বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

"অনেক জায়গায় এই ঘটনাগুলো ঘটার পর তদন্তের দায়িত্বও পুলিশ কর্মকর্তারা পাচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে দিনশেষে জাস্টিস (ন্যায়) পাওয়ারও কোনো ধরনের সুযোগ নেই", বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান।

ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সুস্পষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা না গেলে এখনতো বটেই, পরবর্তী যে রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করবে, তারাও এই বাহিনীকে আবার "মনস্টার" বানিয়ে ব্যবহারের শঙ্কা থাকবে, যা "খুবই উদ্বেগজনক" বলে মনে করছেন তিনি।

অন্যদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে আইনের বাইরে কাজ বা তৎপরতাকে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এই ধরনের ঘটনা ঘটার কারণ হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

সরকার দৃঢ় অবস্থান না নেওয়ার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সেক্ষেত্রে "দক্ষতা ও সাহসের অভাব"কে ফ্যাক্টর হিসেবে দেখছেন এই মানবাধিকারকর্মী।

"অরাজনৈতিক এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলেও এই সরকার অনেক সময় নিয়ে নিচ্ছেন, ফলে পুরো বিষয়টা লেজেগোবরে করে ফেলছেন", বলেন মি. লিটন।

এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পাঠানো লিখিত জবাবে জানানো হয়, "বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিটি ঘটনাকে বিচার- বিশ্লেষণ ও তদন্তের মাধ্যমে যাচাই করে দেখে থাকে। কোথাও যদি পুলিশের হেফাজতে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পুলিশে হস্তান্তরের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটি গুরুত্বসহকারে তদন্তের আওতায় আনা হয়"।

"প্রত্যেক ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়"।


সীমান্তে হত্যা ও রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু

অধিকার-এর প্রতিবেদনে সীমান্তে হত্যা, রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যুসহ আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, চব্বিশের অগাস্ট থেকে পঁচিশের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কমপক্ষে ৩৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে নিহত হয়েছেন ১০ জন।

গত মে মাস থেকে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত কমপক্ষে দুই হাজার ৩৩৩ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বলেও মানবাধিকার সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের, তাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এই সংখ্যা ২৮১-এ পৌঁছেছে।

গত বছরের অগাস্ট থেকে পঁচিশের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৬৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ভুক্তভোগীর এই সংখ্যা ১৮৮।

গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর গতবছর আটই অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ১৫৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।