বাউফলে একাধিক প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ না করে বিল উত্তোলনের অভিযোগ

পটুয়াখালীর বাউফলে টেন্ডার ছাড়া একাধিক প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ না করে বিল উত্তোলনের চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ফ্যাসিস্ট সৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার দোসররা এখনো বাউফল উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে বহাল তবিয়তে আছে। কাজ না করেই বিল তুলে নিচ্ছে আওয়ামী লীগের দোসর কিছু নামধারী ঠিকাদার।
আরও পড়ুন: রায়পুরায় কাউকেই গ্রীন সিগন্যাল দেওয়া হয়নি বলে দাবি মনোনয়ন প্রত্যাশীদের
অভিযোগ রয়েছে, বাউফল উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় টেন্ডারবাজিতে এখনো সক্রিয় ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রোদেলা এন্টারপ্রাইজ, জাইফা এন্টারপ্রাইজ ও ইয়াসীন এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠান। উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগসাজশে তারা বিনা টেন্ডারে বাগিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার কাজ। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক হচ্ছেন যথাক্রমে রুহুল আমিন, শিরীন আক্তার ও সুমন মিয়া। রুহুল আমিনের পিতা আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম খান।
সরেজমিনে জানা যায়, এসব লাইসেন্সের আড়ালে বেনামী ঠিকাদারি কাজ করেছে বাউফল দাশপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দিন তালুকদার ওরফে সবুজ মাস্টার। সবুজ মাস্টার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এবং রুহুল আমিনের আপন ফুফাতো ভাই। আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদার এবং নাজিরপুর-তাতেরকাঠী ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইব্রাহীম ফারুকের সব ঠিকাদারি কাজ বেনামে করতো এ মহিউদ্দিন সবুজ মাস্টার।
আরও পড়ুন: কুলাউড়ায় গ্রাম পুলিশদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন করলেন জেলা প্রশাসক
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিনা টেন্ডারে উপজেলার অসংখ্য কাজ উক্ত ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে। এর মধ্যে ইউ.এন.ও এর বাসভবনের ওয়াল উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য সবুজ মাস্টারের ঘনিষ্ঠ শিরীন আক্তারের মালিকানাধীন মেসার্স জাইফা এন্টারপ্রাইজ কার্যাদেশ পায়। এই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬ লক্ষ টাকা এবং কার্যাদেশ ছিল ৫,৭০,০০০/-।
দ্বিতীয় কাজে ইউ.এন.ও এর বাসভবনের পশ্চিম পাশে চলাচলের জন্য গেটসহ রাস্তা নির্মাণ—এই কাজ সবুজ মাস্টারের ফুফাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা কালাম খানের পুত্র মোঃ রুহুল আমিনের মালিকানাধীন মেসার্স রোদেলা এন্টারপ্রাইজ করেছে। এই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬ লক্ষ টাকা এবং কার্যাদেশ ছিল ৫,৭০,০০০/-।
তৃতীয় কাজে উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম পাশের নিচতলার নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ। এই কাজ সবুজ মাস্টারের ফুফাতো ভাই রুহুল আমিনের বন্ধু সুমনের মালিকানাধীন মেসার্স ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজ করেছে। এই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬ লক্ষ টাকা এবং কার্যাদেশ ছিল ৫,৭০,০০০/-।
প্রাক্কলিত মূল্য ও চুক্তি মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবগুলো কাজেরই ব্যবধান একই ৩০ হাজার টাকা। এ থেকেই বোঝা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে উপজেলা প্রশাসনের আগে থেকেই যোগসাজশ রয়েছে।
এই কাজের অনুসন্ধান করতে গিয়ে সবুজ মাস্টারের আরেক অপকর্মের খোঁজ পাওয়া যায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দিকে মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের পুলের বাজারের আয়রন ব্রিজের মেরামত কাজ টেন্ডার ছাড়াই তার এক ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারের নামে নিয়ে পুরাতন মালামাল দিয়ে সম্পন্ন করেন। স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনজু মিয়ার গোডাউনে রক্ষিত পুরাতন মালামাল দিয়ে মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার সর্বোচ্চ ৩ (তিন) লক্ষ টাকা ব্যয় করে এ মেরামত কাজ সম্পন্ন করেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) টেন্ডারবিহীনভাবে বিশেষ জরুরি ভিত্তিতে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সীমা থাকায় একই ব্রিজের মেরামতের কাজ বেআইনিভাবে দুইটি প্রকল্প দেখিয়ে দুইবারে ১০ (দশ) লক্ষ টাকা প্রকল্প ব্যয় দেখানো হয় (বাউফল উপজেলা পরিষদের ২০ তম রেজুলেশন তারিখ ১৩/১১/২০২৩, ক্রমিক নং ২৪ ও ২৫ পার্ট-১ ও ২)। এভাবে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্বাসের যোগসাজশে মহিউদ্দিন সবুজ মাস্টার সরকারের আনুমানিক ৭ (সাত) লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ সব নিয়ে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী সরকারি প্রকৌশলী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এসব কাজ উপজেলা প্রকৌশলীর মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করে হওয়ার কথা। কিন্তু অজানা কারণে এসব কাজ উপজেলা প্রশাসন বিনা টেন্ডারে করাচ্ছে। আদাবাড়িয়া ব্রিজের কাজের ব্যাপারে বলেন, একই কাজ দুইবার দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করার নজির বাংলাদেশে খুব কম রয়েছে। এসব দুর্নীতির তদন্তসাপেক্ষে বিচার হওয়া উচিত।
সরেজমিনে কাজ পরিদর্শনকালে দেখা যায়, শ্রমিকরা কাজ করছে। কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। রাস্তার সুড়কি উঠে যাচ্ছে। ওয়ালের কাজও সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। পুরনো গেট লাগিয়ে রং করা হয়েছে।
সরেজমিনে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। কাজের তত্ত্বাবধানকারী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্বাসকে বার বার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, বাউফলে এখনো সব আগের মতোই আছে। আগে মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অপব্যবহার করে কাজ নিত, এখন একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র ছায়ায় থেকে কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বিনা টেন্ডারে কাজ মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টারের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারের নামে নিচ্ছে, যাতে মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার কাজ করতে পারে। বাউফলের এক রাজনৈতিক দলের নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই মহিউদ্দিন ওরফে সবুজ মাস্টার অবৈধ ঠিকাদারি ব্যবসার মাধ্যমে ঠিকমতো কাজ না করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই সরকার পালিয়ে গেলে এখন অন্য একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এখনো তারা সক্রিয়। এই সরকারের কর্মকর্তারা এসব আওয়ামী ঠিকাদারদেরকে সমর্থন করে বিনা টেন্ডারে কাজ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে সবুজ মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত নন মর্মে দাবি করেন।
এ বিষয়ে জানতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমিনুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।