রক্তে লেখা স্বাধীনতা: ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের গর্বের উদীয়মান সূর্য

Sanchoy Biswas
মোহাম্মদ নেওয়াজ আহমেদ পরশ
প্রকাশিত: ৬:৩২ অপরাহ্ন, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২:৩৩ পূর্বাহ্ন, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
মোহাম্মদ নেওয়াজ আহমেদ পরশ
মোহাম্মদ নেওয়াজ আহমেদ পরশ

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর এক অবিনাশী আলোকচিহ্ন। প্রতিটি বছরের মতো এবারও দিনটি আসে জাতির হৃদয়ে ব্যথা ও গৌরবের এক অদৃশ্য মিশ্রণ নিয়ে—যে ব্যথা আমাদের হারানো সেরা সন্তানদের জন্য, আর যে গৌরব একটি অসম্ভব যুদ্ধ জয় করে লাল–সবুজ পতাকাকে প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু বিজয় দিবস কেবল স্মরণ বা আনুষ্ঠানিকতার দিন নয়; এটি আত্মসমালোচনার, আত্মবীক্ষণের, ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিন। পাঁচটি দশক পার করার পরও প্রশ্নগুলো একই: আমরা কি আমাদের বিজয়কে ধারণ করতে পেরেছি? যে মূল্যবোধের জন্য একটি জাতি অকুতোভয়ে যুদ্ধ করেছিল, তা কি আমাদের জাতীয় জীবনে অটুট রয়ে গেছে?

জাতির জন্মরেখায় ১৬ ডিসেম্বর

আরও পড়ুন: উসমান হাদী গুলিবিদ্ধ: সন্ত্রাসীদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার এখনই সময়

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। শুধু একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র নয়, এটি ছিল একটি জাতির নিজের পরিচয়, মর্যাদা ও স্বাধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম। একাত্তর ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। গণহত্যা, নির্বিচারে ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবী হত্যা—যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কজনক উদাহরণ হিসেবে স্মরণীয়। অথচ সেই ঘন অন্ধকার থেকেই বাংলার মানুষ জন্ম দেয় স্বাধীনতার সূর্যকে। জয় শুধু সামরিক নয়, ছিল সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি একটি সভ্যতার পুনর্জাগরণ।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ—আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?

আরও পড়ুন: মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা- প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের ভিত্তিমূল ছিল মানবিক বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সেই চারটি স্তম্ভ ছিল জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু গত পাঁচ দশকে আমরা অনেক সময় এই অঙ্গীকার থেকে সরে গেছি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দারিদ্র্য, বৈষম্য, শিক্ষা–স্বাস্থ্য সংকট এবং নৈতিক অবক্ষয় আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও, সব হতাশার ভিড়ে আশার আলো আছে। আছে উন্নয়নযাত্রা, দারিদ্র্য হ্রাস, নারীশিক্ষা বিস্তার, কৃষি উৎপাদনের সাফল্য, প্রযুক্তিতে নতুন প্রজন্মের উত্থান। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়ন–অগ্রগতির এক "মিরাকল কেস স্টাডি"। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—উন্নয়ন কি মূল্যবোধের বিকল্প হতে পারে? যে মানবিকতাকে মুক্তিযোদ্ধারা বুকে নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি?

বিজয়ের গল্প—যে গল্প বিশ্বকে বিস্মিত করেছিল

মাত্র নয় মাসে এমন এক সশস্ত্র জনগণের জন্ম হয়েছিল যারা শত্রুপক্ষের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অনভিজ্ঞ, অস্ত্র ছিল কম, প্রশিক্ষণ ছিল সীমিত, তবুও অসীম সাহস ছিল। কেউ ছিলেন ছাত্র, কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ শিক্ষক, কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ সাংবাদিক, কেউ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, তবুও জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে। বিশ্বের কাছে এটি এক বিরল যুদ্ধ—যেখানে জাতি অস্তিত্বের প্রশ্নে একত্র হয়েছিল। যে কারণে ১৬ ডিসেম্বর কেবল একটি দিন নয়; এটি জাতির সম্মিলিত আত্মত্যাগের প্রতীক। কিন্তু এই আত্মত্যাগ কি আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছি?

আজও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অভাব–অনটনে দিন কাটান। অনেক শহীদ পরিবারের সদস্য রাষ্ট্রীয় সেবার বাইরে। ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতি তাদের আরও কষ্ট দিয়েছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যা—অপরাজেয় জাতিকে পঙ্গু করার শেষ চেষ্টা

১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা শেষ মুহূর্তে জাতিকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছিল। হত্যা করেছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী—যারা নতুন রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেন। এই গণহত্যা শুধু শারীরিক হত্যাই ছিল না; এটি ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে অক্ষম করার প্রয়াস। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—মেধা হত্যা হলেও জাতির মননকে হত্যা করা যায়নি।

বিজয়ের পর পাঁচ দশক—অর্জন ও চ্যালেঞ্জের খতিয়ান

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অসাধারণ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন, গড় আয়ু বৃদ্ধি—সবই অর্জন।

কিন্তু নতুন বাংলাদেশ এখনও অসমতার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। শহর–গ্রামের বৈষম্য, শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নৈতিকতার সংকট, দুর্নীতি, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক স্বচ্ছতার অভাব—এই সবকিছু এখনও আমাদের অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একাত্তরের চেতনাকে ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক স্লোগানে, কিন্তু জীবন–যাপন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় সেই চেতনা পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও প্রশ্নটি তাই জোরালো: আমরা কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি?

বিজয় দিবস: স্মরণ নয়, দায়িত্ববোধের দিন

বিজয় দিবস মানে শুধু পতাকা ওড়ে এমন নয়; বিজয় দিবস মানে নিজের ভেতরের অমানবিকতা, বৈষম্য, অন্যায়, দুর্নীতি ও ঘৃণাকে পরাজিত করার অঙ্গীকার।

বিজয়কে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন দক্ষ, মানবিক, নৈতিক এবং উদার রাষ্ট্রপরিচালনা। প্রয়োজন দায়িত্বশীল নাগরিক সংস্কৃতি। একাত্তরের চেতনা ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ না করলে রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব

আজকের তরুণরাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধকে শুধুই বইয়ের গল্প হিসেবে জানলে হবে না; জানতে হবে স্বাধীনতার ইতিহাস কীভাবে তাদের জীবনের প্রতিটি অধিকারকে নিশ্চিত করেছে।

তরুণদের সামনে দুটি দায়িত্ব—

১) ইতিহাসকে জানতে হবে

২) মূল্যবোধকে ধারণ করতে হবে

একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখে তার ইতিহাসবোধ। মূল্যবোধহীন শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি হয় না।

আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি—মানুষ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কখনোই অস্ত্র ছিল না, কখনোই অর্থ ছিল না—সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষ।

যে মানুষ খেতে পায়নি, ঘর ছিল না, তবুও যুদ্ধ করেছে—কারণ স্বাধীনতা ছিল সবচেয়ে বড় সম্পদ। আজও এই মানুষরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্রকে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা ও সুযোগ নিশ্চিত করে মানুষের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বিজয়ের আলোয় আমাদের পথচলা

বিজয় দিবস স্মরণ করিয়ে দেয়—একটি জাতি চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। আজকের বাংলাদেশকে তাই নতুন করে ভাবতে হবে—আমরা কোথায় ব্যর্থ হলাম, কীভাবে ভুলগুলো সংশোধন করা যায়, কীভাবে মানবিকতা, সততা, মূল্যবোধ ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যায়, কীভাবে সকল নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা যায়। বিজয় দিবস আমাদের শেখায়—মানুষের প্রতি অবিচার করলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না।

১৬ ডিসেম্বর—একটি অনন্ত যাত্রার নাম

আজ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করি—বিজয় কেবল একটি ঘটনা নয়, এটি একটি যাত্রা। এই যাত্রা শেষ হয়নি—এই যাত্রা চলমান। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের রক্তে যে লাল–সবুজ গর্বের স্রোত বইছে, সেটাই আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের দায়িত্ব ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা, বীরদের সম্মান করা, দেশকে ভালোবাসা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সৎ রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখা। বিজয় দিবসের এই প্রভাতে আমরা যেন শপথ নিতে পারি-বাংলাদেশকে আমরা শুধু উন্নত রাষ্ট্র নয়, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলব। যে রাষ্ট্র একাত্তরের আদর্শ, ত্যাগ ও চেতনাকে বুকে নিয়ে সামনে এগোবে। রক্তে লেখা স্বাধীনতা আমাদের অতীতের সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মারক। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গর্বের উদীয়মান সূর্য, যা শুধু বিজয় নয়, বরং জাতির অটুট একতা, সাহস ও স্বপ্নের প্রতীক। এই দিনটি মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গের মূল্য অপরিসীম এবং সেই ঐতিহ্য আমাদের ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক।

লেখক: মোহাম্মদ নেওয়াজ আহমেদ পরশ