ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল-নজরুল বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উর্দু বিভাগ- এর যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন “দ্যা রোল অব মুহাম্মাদ ইকবাল অ্যান্ড নজরুল ইসলাম ইন ন্যাশনাল অ্যাওয়েকেনিং”। আজ ৯ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গোলাম মাওলার সভাপতিত্বে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিআইআইটি’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এম. আবদুল আজিজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান। সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খাজা মুহাম্মদ ইকরামুদ্দিন।
আরও পড়ুন: সরকারের আশ্বাসে প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি আপাতত স্থগিত
ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত মেধা, উদ্ভাবন এবং যৌথ জ্ঞানচর্চার একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিকশিত হয়। এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন সেই জ্ঞানচর্চা ও সহযোগিতার পরিসরকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে। তিনি এটিকে কেবল একাডেমিক আলোচনা নয়, বরং নেটওয়ার্কিং ও মানবিক মূল্যবোধেরও এক অনন্য উদযাপন হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা পারস্পরিক বন্ধন ও সহযোগিতার ক্ষেত্রকে সুদৃঢ় করবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এই সম্মেলনের আলোচনায় ইকবাল ও নজরুলের দর্শন থেকে নতুন অন্তর্দৃষ্টি ও বাস্তব দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এই অভ্যুত্থান এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘জাগরণের দর্শন’ নিয়ে সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু তাই সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে, ইকবাল ও নজরুলের চিন্তাধারার সঙ্গে এই প্রেক্ষাপটের সংযোগ বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাকে আরও গভীর করে তুলবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত বাস্তব শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা আমাদের জ্ঞানকে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে সহায়ক হবে।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়ার আসনে এনসিপির মনোনয়ন নেওয়া কে এই জোবায়ের?
তিনি আরও বলেন, নজরুল ও ইকবাল দু'জনেরই স্বকীয়তা ছিল ও নিজস্বতা ছিল। দেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের চিন্তা-দর্শন নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের কনফারেন্স আগামীতে সাহিত্য চর্চা বৃদ্ধিতে, ইনটেলেকচুয়াল আইডিয়ার উন্নয়নে এবং জ্ঞান সাধনার প্রাকটিক্যাল গাইডলাইনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এই ধরনের আয়োজনে এবং মানবতার কল্যাণে জ্ঞান ও সহযোগিতার এই যাত্রায় ভবিষ্যতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।
বিআইআইটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এম. আবদুল আজিজ বলেন, ইকবাল ও নজরুল উপমহাদেশের মুসলিম আত্মচেতনা, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও মানবমুক্তির দুই আলোকিত নক্ষত্র। ভাষা ও ভৌগোলিক পার্থক্য থাকলেও ইকবাল ও নজরুলের লক্ষ্য ছিল এক- আত্মচেতনা ও মানবমুক্তির জাগরণ। ইকবাল ও নজরুল - দুজনেই মুসলিম সমাজের আত্মজাগরণ, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বাধীন চিন্তার প্রতীক; তাঁদের ভাবনা আজও আমাদের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পুনর্জাগরণের অনন্ত প্রেরণা। ইকবাল ছিলেন চিন্তার বিপ্লবী, নজরুল ছিলেন হৃদয়ের বিপ্লবী; একজন যুক্তির দীপ্তি, অন্যজন অনুভবের উষ্ণতা। উভয়েই ইসলামী ভাবধারাকে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত করে মানবতার মুক্তি ও মর্যাদার বার্তা দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, মুসলিম সমাজ যখন উপনিবেশিক শাসন, আত্মবিস্মৃতি ও সাংস্কৃতিক দাসত্বে নিমজ্জিত ছিল, তখন ইকবাল তাঁর চিন্তায় আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর কবিতায় আত্ম-অনুধ্যান, স্বাধীন চিন্তা ও মানবিক উৎকর্ষের আহ্বান প্রকাশ পেয়েছে। ইকবাল বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের মুক্তি আত্মচেতনার মধ্য দিয়েই সম্ভব- যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিফলিত হয়। আর নজরুল ছিলেন সংগ্রামী ও মানবিকতার কবি। তাঁর রচনায় বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবমুক্তির সুর ধ্বনিত হয়েছে। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশ ও সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উঁচু করেছিলেন এবং নিপীড়িত মানুষের আত্মবিশ্বাস ও মুক্তির প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।
দৈনিক আমারদেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলা ও উর্দু সাহিত্যের দুই মহত্তম কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল একই লক্ষ্য ‘মুসলিম রেনেসাঁ’র স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আজীবন লিখে গেছেন। দুজনেই এমন এক সময়ে জন্মেছিলেন, যখন উপমহাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। সেই কলোনিয়াল সাবজুগেশনের মধ্যেও তারা মুসলমানদের জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন। মুসলমানদের দুর্দশা তারা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন এবং তাদের লেখার মূল সুর ছিল জাতির আত্মচেতনা ও পুনর্জাগরণ।
তিনি আরও বলেন, ইকবাল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী মানুষ। অক্সফোর্ড থেকে মাস্টার্স, জার্মানি থেকে পিএইচডি আর লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি করেছেন তিনি। ফরমাল শিক্ষায় তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অন্যদিকে নজরুলের এমন সুযোগ হয়নি, কিন্তু তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে ফারসি ভাষায় তার দক্ষতা অনন্য। তার ফারসি কবিতার অনুবাদে এমন সৌন্দর্য ও শক্তি আছে, যা বাংলা সাহিত্যে বিরল।
মাহমুদুর রহমান ইকবালের বিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়া’ ও ‘জবাব-এ-শিকওয়া’ এবং নজরুলের ‘আনোয়ার’ কবিতার মধ্যে ভাবগত মিলের দিকটি তুলে ধরে বলেন, ‘ইকবাল ১৯১৩ সালে যেমন মুসলমানদের আত্মসমালোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন; নজরুল ১৯২২ সালে একই সুরে লিখেছিলেন ‘আনোয়ার বেইমান মরা নাই জানোয়ার, কোথা খোঁজ মুসলিম শুধু কোন জানোয়ার?’ দুজনেই মুসলমানদের নিস্তেজতা, আত্মবিস্মৃতি আর আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
তিনি বলেন, আজও মুসলিম রেনেসাঁর সেই আহ্বান প্রাসঙ্গিক। গাজায় গণহত্যা কিংবা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন, সবই প্রমাণ করে যে নজরুল-ইকবালের খোঁজা সেই প্রকৃত মুসলমান এখনো আমাদের সমাজে অনুপস্থিত। তাই এই দুই কবির কাব্যচর্চা আজও অপরিহার্য। মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে নজরুল ও ইকবাল দু'জনই কাজ করেছেন। তাদের কাব্য চর্চা করা বর্তমান সময়েও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। উপমহাদেশের পরিস্থিতি উন্নয়নে নজরুল ও ইকবালকে বেশি বেশি জানা, পড়া ও চর্চা করার কোনো বিকল্প নেই।
আইআইইউএম এর অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান জুলাই ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে ইকবাল ও নজরুল পাঠ শীর্ষক প্রেজেন্টেশনটিতে বিশ্লেষণ করেন কীভাবে মুসলিম দার্শনিক ও কবি মুহাম্মদ ইকবাল এবং কাজী নজরুল ইসলাম ন্যায়, মর্যাদা ও আত্মমর্যাদার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জুলাই ২০২৪-পরবর্তী সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, ইকবাল ও নজরুল শুধু ইতিহাসের কবি নন- তাঁরা বাংলাদেশের জন্য নৈতিক দিকনির্দেশনা। তাঁদের বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্ম একত্রিত করে গড়ে তোলা যায় আত্মমর্যাদাবান ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ।
তিনি বলেন, ইকবাল ও নজরুল উভয়েই ঔপনিবেশিক শাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের জুলাই ২০২৪-এর গণজাগরণ তাঁদের ন্যায়, স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানের বার্তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। ইকবালের খুদি তত্ত্বে আত্মসচেতনতা, সাহস ও নৈতিকতার আহ্বান ছিল। তিনি পশ্চিমা চিন্তার অন্ধ অনুসরণ না করে মুসলমানদের সৃজনশীলতা ও নিজস্ব চিন্তাশক্তি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান। তাঁর চিন্তা পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি গঠন করে। আর “বিদ্রোহী কবি” নজরুল ছিলেন অবিচার, বৈষম্য ও দমননীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর। আনন্দময়ীর আগমনে, রাজবন্দীর জবানবন্দিসহ তাঁর রচনাগুলো নিপীড়িতদের ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশে ইকবালের চিন্তা প্রায় উপেক্ষিত হয়; এমনকি তাঁর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও তাঁর নাম মুছে ফেলা হয়। নজরুলের ইসলামিক চিন্তা ও দার্শনিক গভীরতাও প্রায়ই বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই দুই মনীষীর চিন্তা-দর্শন পুনরুদ্ধার না করলে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইকবাল ও নজরুল উভয়েই এক আত্মিকভাবে জাগ্রত, ন্যায়নিষ্ঠ ও নৈতিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশের ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও নৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে তাঁদের চিন্তাধারা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমা চিন্তার অন্ধ অনুসরণ ও আত্মনির্ভরশীলতার অভাব আজও ইকবালের সতর্কবাণীকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার জন্য ইকবালের আত্মসচেতনতা ও নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা পুনরুদ্ধার জরুরি- যা বাঙালির আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করবে।
উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বলেন, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় জাগরণে ইকবাল ও নজরুলের দার্শনিক ও সাহিত্যিক অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা এবং বিশ্বব্যাপী তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে একটি নৈতিক ও আলোকিত মানবিক চেতনা গড়ে তোলা। এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক সংযোগ ও গবেষণার ধারাবাহিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করবে ।
উল্লেখ্য, জাতীয় জাগরণে ইকবাল ও নজরুলের ভূমিকা শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কাতার, মিশর, কানাডা, জার্মানী, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ইরান, তুরস্ক, নেপাল, মালয়েশিয়া, মরিসাস, জাপানসহ মোট ২২টি দেশের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও গবেষকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। তারা এখানে মোট ১৮টি সেশনে ১২৭টি মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। কনফারেন্সের অন্যতম আকর্ষণ হলো দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান কবিদের অংশগ্রহণে আয়োজিত জমজমাট মুশায়েরা ও গজল সন্ধ্যা।





