ইরানের রত্ন

ডালিম যেভাবে গড়ে তোলে সংস্কৃতি, খাদ্য, হস্তশিল্প ও ঐতিহ্য

Sadek Ali
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১:৩২ অপরাহ্ন, ২৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১:৩৩ অপরাহ্ন, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

শরৎ যখন ইরানের আকাশজুড়ে নরম কুয়াশা টেনে দেয়, গাছপালার পাতায় নামে সোনা-তামার ছোঁয়া—ঠিক তখনই দেশজুড়ে শুরু হয় ডালিম উৎসব। পার্সিয়ান ভাষায় “আনার” নামে পরিচিত এই রুবি-লাল ফল শুধু একটি মৌসুমি ফল নয়; ইরানিদের কাছে এটি প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জীবনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে বহু শতাব্দী ধরে। প্রাচীন পারস্য সভ্যতা থেকে আধুনিক ইরান পর্যন্ত—ডালিম তাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, খাদ্যাভ্যাস ও শিল্পকলার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

বাজারে ঢুকলে দেখা যায়—প্রতিটি দোকান যেন ইরানি ঐতিহ্যের রঙিন প্রদর্শনী। পাহাড়ি অরণ্য থেকে মরুভূমি অঞ্চলের খামার—সব জায়গা থেকেই আনা টাটকা ডালিম সারি সারি সাজানো। কৃষকরা জানান পুরনো চাষপদ্ধতির গল্প, দোকানিরা বলেন লোককাহিনি—কোথাও আবার শিশুরা শেখে, ডালিমের মতোই জেগে থাকতে শিখতে হবে হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলের হামলার পরও গাজায় যুদ্ধবিরতি ‘ঝুঁকিতে নয়’: ট্রাম্প

ডালিম: ইরানি সংস্কৃতির ‘লাল রত্ন’

প্রাচীন পারস্য সভ্যতা থেকে বর্তমান ইরান পর্যন্ত ডালিমকে সৌভাগ্য, প্রাচুর্য ও জীবনশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। শরৎ মৌসুমে বাজারে ওঠে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা ডালিম। কৃষক থেকে বিক্রেতা—সবার কাছে এ ফল শুধু পণ্য নয়, ঐতিহ্য বহনকারী একটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলের নতুন হামলায় গাজায় নিহত ১৮, যুদ্ধবিরতি নিয়ে শঙ্কা

সাহিত্যে ও লোকবিশ্বাসে ডালিমের অবস্থান

ইরানি কবিতা ও সাহিত্যে ডালিম সৌন্দর্য, প্রেম ও পুনর্জন্মের উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাফিজ ও সাদীর মতো ক্ল্যাসিক কবিরা তাদের কবিতায় ডালিমকে মানবিক আবেগের প্রতীক হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। লোকজ ঐতিহ্যেও ডালিমকে মনে করা হয় আশীর্বাদ ও মঙ্গলের প্রতীক।

রান্নায় অপরিহার্য উপাদান

ইরানি রান্নায় ডালিমের ব্যবহার বহুমুখী। সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ফেসেনজান—ডালিম সিরাপ, রস ও বাদামের সমন্বয়ে তৈরি ধীর আঁচে রান্না করা বিশেষ পদ।

এছাড়া সালাদ, মাংসের ঝোল, ডিপ ও ডেজার্টেও ডালিমের বিচি ও রস ব্যবহার করা হয়।

উৎসব ও অতিথি আপ্যায়নে এ ফল অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

ইয়ালদা নাইটে ডালিমের বিশেষ গুরুত্ব

শীতের দীর্ঘতম রাত ইয়ালদা নাইট প্রতিটি ইরানি পরিবারে ডালিম কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে থাকে। লাল রঙকে সূর্য ও আলোয়ের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যা অন্ধকারকে পরাজয়ের বার্তা দেয়। এদিন কবিতা পাঠ, পারিবারিক সমাবেশ ও খাবারের টেবিল সম্পন্ন হয় ডালিম দিয়ে।

হস্তশিল্পে ডালিমের নকশা

পারস্য গালিচা, সিরামিক, ধাতুকর্ম, কাঠের খোদাই ও গহনায় ডালিম মোটিফ বহুল ব্যবহৃত। শিল্পীরা এটিকে ‘সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরেন। ফলে ডালিম ইরানি কারুশিল্পের নান্দনিক অংশ হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও রপ্তানি

ডালিম ইরানের শীর্ষ রপ্তানি কৃষিপণ্যের মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইয়াজদ, ফার্স ও মার্কাজি প্রদেশে বাণিজ্যিক পরিসরে ব্যাপক চাষ হয়। ডালিম, ডালিম রস ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশটি।

ডালিম ইরানে কেবল একটি ফল নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার, খাদ্যাভ্যাস, হস্তশিল্প এবং অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ইরানিদের কাছে ডালিম এখনো জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারক।


সূত্র: মেহের নিউজ