মালিক ইমরান আত্মগোপনে, কথিত উচ্চ বংশীয় গরু-ছাগল উধাও

আলোচিত সাদিক এগ্রো উচ্ছেদ

Abid Rayhan Jaki
মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব
প্রকাশিত: ৭:৩১ অপরাহ্ন, ২৭ জুন ২০২৪ | আপডেট: ৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, ২৮ জুন ২০২৪
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার কথিত উচ্চ বংশীয় ও খানদানি গরু-ছাগল বিক্রি করে আলোচিত ‘সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম’- বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। অভিযানের একপর্যায়ে খামারের আবাসিক কয়েকজন কর্মচারী বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুরো খামারটি উচ্ছেদ করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে রামচন্দ্রপুর খালের দখল করা অংশ। 

উচ্ছেদ অভিযান সরেজমিন দেখা যায়, সিটি কর্পোরেশনের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার পর সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে ভাঙার কাজ শুরু করে। সাদিক অ্যাগ্রো লিমিটেড অবৈধভাবে খাল ও সড়কের জায়গা দখল করা জায়গা এবং ওই অংশে রিকশার গ্যারেজ ও কিছু বস্তিঘর বুলড্রোজার দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হযেছে। 

আরও পড়ুন: নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেবো: ধর্ম উপদেষ্টা

উচ্ছেদ অভিযানের সময় ছাগল–কাণ্ডের আলোচিত সেই ১৫ লাখ টাকার ছাগলটিসহ অন্যান্য গবাদিপশু সরিয়ে নেওয়া হয়। সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক গবাদিপশুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সড়কসংলগ্ন সাতমসজিদ আবাসিক এলাকায় খামারটির অবস্থান। তবে অভিযান খবর আগেই ফাঁস হওয়ায় বুধবার রাত থেকেই সেখান থেকে গরু, ছাগল ও বিভিন্ন মালামাল সরিয়ে নেয় সাদেক এগ্রোর লোকজন। 

সরেজমিন দেখা যায়, উচ্ছেদ অভিযানের সংবাদ পেয়ে খাল ভরাট করে বসানো বস্তিঘরের বাসিন্দারা ছাউনির টিন ও বাঁশ-কাঠ খুলে ফেলতে শুরু করেন। বেলা সাড়ে ১১টার পর ওই স্থানে সিটি করপোরেশনের ভারী যন্ত্রপাতি নেওয়া হয়। ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহে আলম, ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫–এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদসহ অন্য কর্মকর্তা ও  কয়েক প্লাটুন পলিশের উপস্থিতিতে অবৈধ স্থাপনা ভাঙার কাজ শুরু হয়। প্রথমে খামারের পশ্চিম অংশ ভাঙার কাজ শুরু হয়। এর নিচে সাদিক অ্যাগ্রোর কার্যালয় ছিল। আর ওপরে টিনের ছাউনির একটি কক্ষে খামারের কর্মচারীদের থাকার কক্ষ ছিল। স্থাপনাটি ভাঙার কাজ চলাকালে দোতলার কক্ষে দুজন অবস্থান নিয়ে উচ্ছেদে বাধা দেন। পরে পুলিশ সদস্যদের সাহায্যে তাদেরকে সেখান থেকে সরানো হয়। পরে ওই অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ করা হয়নি উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদের হিসাব

এ সময় একই সঙ্গে পেছনের দিকে থাকা অবৈধ স্থাপনাগুলোও ভাঙার কাজ শুরু করেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। বস্তিঘর ও রিকশার গ্যারেজের টিনগুলো আগেই সরিয়ে নেওয়ার কারণে শুধু বাঁশের কাঠামোগুলো ছিল। সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়।

উচ্ছেদ অভিযান চালানো ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হচ্ছে না। খালের জায়গা যে বা যারা দখল করে রেখেছে, তাদের উচ্ছেদে এ অভিযান চালানো হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, অভিযানে দেখেছেন রামচন্দ্রপুর খালের তীর দখল করে স্থাপনা করা হয়েছে। সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাইকে আইন মেনে ব্যবসা করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান নয়। আমাদের অভিযান অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে।

মোকাব্বির আহম্মেদ বলেন, সাদিক অ্যাগ্রোর মালিককে ঈদের আগেও আমিরা নোটিশ দিয়েছি। অবৈধ স্থাপনা থাকলে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমরা ঈদের আগে উচ্ছেদ অভিযান করিনি কারণ এর ফলে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো। আমরা এমনটা চাইনি বলে উচ্ছেদে যাইনি। সেই নোটিশের কোনো ব্যবস্থা নেননি।

গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ৭ নম্বর সড়কে সাদিক এগ্রোর আরেকটি খামারও উচ্ছেদ করেছে ডিএনসিসি। ওই খামারের পাশে থাকা অন্যান্য অবৈধ স্থাপনাও ভাঙছে সিটি করপোরেশন।

পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানি উপলক্ষে পশুর বাজারে কোটি টাকার গরু ও ১৫ লাখ টাকায় ছাগল বিক্রি করে আলোচনায় আসেন সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন।  বেসরকারি টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ইমরান দাবি করেন শত বছরের বংশ পরস্পরায় উচ্চ বংশীয় গরুটি আমেরিকা থেকে আমদানি করা, ও  ছাগলটি পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে আমদানি করা। গরুটি ও দেশে আমদানি নিষিদ্ধ প্রতারণা জালিয়াতি করে তাদেরকে গ্রুপ পশু সম্পদ বিরাট থেকে এটি নেয়। আর কথিত কামদানি ছাগলটি মাত্র এক লাখ টাকায় যশোর থেকে ক্রয় করে বলে গণমাধ্যমে স্বীকার করেছে। সাদিক এগ্রোর বিতর্কিত ব্যবসায়ী ইমরান মোহাম্মদপুরের বেরিবাধ এলাকায় সরকারি বিপুল জায়গা দখল করে ২০০৮ সালে গড়ে তোলেন সাদেক এগ্রো ফার্ম। এলাকায় একজন দখলদার ও ভূমিদস্যুহিসেবে চিহ্নিত। তার নিকট থেকে গরু ছাগল ক্রয় করে দুটি পরিবারই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে । তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎস নিয়ে দুদকের মুখোমুখি হয়েছে।

কোটি টাকার ‘বংশীয় গরু’ এবং ১৫ লাখ টাকার ‘খান্দানি ছাগলকাণ্ড’ কোরবানি ঈদের আগ থেকেই আলোচনার শীর্ষে ছিল মোহাম্মদপুর বেড়িবাধের ‘সাদিক অ্যাগ্রো’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সর্বমহলেই বক্তব্য দিয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়ে আসছিলেন অ্যাগ্রোর মালিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী ইমরান। ডিএনসিসি যখন উচ্ছেদ অভিযান চালায় সেখানে ছিলেন না ইমরান।  

মোবাইল ফোনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এই জমির মালিক না, একজন ভাড়াটিয়া। তাই উচ্ছেদ অভিযানে আমার কিছু যায় আসে না। আমি অন্য জায়গায় চলে যাব। সিটি করপোরেশন যে জায়গাটা খাল বলে দাবি করছে, সেটির মালিক আমি না। এই জায়গার মালিক এই স্থাপনার দ্বিতীয় তলায় থাকেন। তিনি তার জায়গায় স্থাপনা করেছেন, আমি নিচতলা ভাড়া নিয়েছি। মালিক নিজেই দ্বিতীয় তলায় থাকেন। খাল ভরাটসহ যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই মালিকের করা। আমার কিছুই না।’ ইমরান বলেন, আমি তার জায়গা ভাড়া নিয়েছি নিচতলায়। দ্বিতীয় তলায় যেহেতু তিনি থাকেন এবং সিটি করপোরশন যদি মনে করে যে এটা ভেঙে দেবে, তো ভেঙে দিতে পারে।

ইমরান আরও বলেন, ‘আমি যে ভাড়া নিয়েছি, এটার ডিডের কাগজপত্র আমার কাছে আছে। তাই আমি এটার মালিক, বললেই হবে না। আমি খালসহ ভাড়া নেইনি। উনি স্থাপনা বানিয়েছে, সেই নিচতলায় আমি ভাড়া নিয়েছি।’

এই সাদিক এগ্রো থেকে কথিত ‘উচ্চবংশীয়’ এক কোটি টাকার গরু কিনেন এর আতিকের ভাতিজা শাকের। ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল কিনতে গিয়ে আলোচনায় আসেন এনবিআরের সদ্য সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ওরফে ইফাত। এছাড়াও কথিত উচ্চ বংশীয় শত বছরের ধারাবাহিকতয় গরুটি বিক্রি করা হয় এক কোটি টাকা দামে।

পবিত্র ঈদুল আজহার আগে এই ছাগল কেনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ছাগলটি ফিরিয়ে দেন ইফাত। পরে মতিউরকে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডিন্ট পদ থেকে সরিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের আভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন ইতোমধ্যে মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ ও তার ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান  অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।  যাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে তারা হলেন, মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধুরী, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত, প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান (ইপসিতা), ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান (অর্ণব) এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইরফানুর রহমান ইরফান। এই আট জনের সকল ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।