আলোচিত সাদিক এগ্রো
খানদানি বাটপার ইমরান, রমজানে দুস্থদের গোস্ত বিক্রির টাকাও জমা দেন নি

কোটি টাকায় গরু ও ১৫ লাখ টাকায় ছাগল বিক্রি করতে কথিত উচ্চ বংশীয় খানদানি জাতের আবিষ্কারক সাদিক এগ্রোর মালিকের বিরুদ্ধে খানদানি প্রতারণার একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। পশু লালন-পালন বিক্রি প্রতারণা ও চোরাকারবারে ইমরান এখন শীর্ষে। কুরবানীর হাটে প্রতিদিন উচ্চ বংশীয় গরু-ছাগল নিয়ে গণমাধ্যমে হইচই শুরু করলেও তার প্রতারণা ধরা পড়ায় ঈদের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছে ইমরান। শুধু ক্রেতাদের সঙ্গেই প্রতারণা নয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় অন্যখামারিদের সঙ্গে বাটপারি ও নির্যাতণেও বহুল আলোচিত সাদিকে এ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। জালজালিয়াতির মাধ্যমে আমদানী করা ব্রাহামা গরু জব্দের পর সেগুলো আবার কৌশলে নিলামে তুলে কব্জায় নিয়েছে। কিন্তু নিলামের অর্থ পরিশোধ করেনি ব্রাহামা গরুর দাম। উল্টো প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমান নগদ সহায়তা। সাদিক এ্যাগ্রোর একের পর এক প্রতারণা ও বাটপারি সামনে আসার পর আজ বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ টিম দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। তিনি বলেন সাদিক এ্যাগ্রো যেসব ব্রাহামা গরু নিলামে ক্রয় করে পবিত্র রমজানে ন্যায্য মূল্যে গোস্ত বিক্রির কথা বলছে সেই গরুগুলো আমরা জীবিত পেয়েছি। গরু গুলো জব্দ করা হয়েছে।’
ইমরানের হাতে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হন বহু খামারি। তাদের একজন কাশফুল এ্যগ্রোর মালিক শহীদুল ইসলাম সাঈদ। তিনি জানান, তিনি বাংলাদেশ ডেইরী ফার্মার্স এসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ২০১৮ সালে সিলেটের খামারীদের ট্রেইনিং করানোর অপরাধে ইমরান তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলে এবং তাকে নানাভাবে হয়রানী করেন। বিডিএফএর গঠণতন্ত্র অনুসারে কারও খামার না থাকলে সে কার্যনির্বাহী কমিটিতে থাকতে পারবে না। জাহিদ হোসেন নামে এক খামারি খামার বন্ধ করে দেওয়ায় তাকে দাপ্তরিক প্রক্রিয়ায় বাদ না দিয়ে সংগঠনের পিয়নের মাধ্যমে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বহিস্কার করেন। প্রতিবাদ করায় কথিত অসদাচরণের অভিযোগ তুলে সাঈকে বহিস্কার করা হয়। সাঈদ আরও বলেন, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান ২০১৮ সালে খামার বন্ধ করে দেন। কিন্তু সাদিক এ্যাগ্রোর ইমরানের আজ্ঞাবহ হওয়ায় তিনি এখনো সাধারণ সম্পাদক।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেবো: ধর্ম উপদেষ্টা
শহীদুল ইসলাম সাঈদ বলেন, খামারিরা নিজস্ব প্রয়োজনে বিভিন্ন সোর্স থেকে ওষুধ, ভ্যাকসিন ও প্রিমিক্স সংগ্রহ করতে পারেন। আল-আমিন তালুকদার রুবেল নামে একজন খামারি নিজের খামারের জন্য ভারত থেকে ‘রক্ষা এফএমডি’ ভ্যাকসিন আনে। ইমরান নিজেও রুবেলের কাছ থেকে ভ্যাকসিন নেন। কিন্তু কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হওয়ায় রুবেলকে মধ্যরাতে বাসা থেকে পুলিশ দিয়ে তুলে নেওয়া হয়। থানায় প্রভাবখাটিয়ে দুইদিন আটকে রাখা হয়। পরে প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তার বিরুদ্ধে চোরাচালানের মামলা দেওয়া হয়। আর গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, চোরাই ভ্যাকসিনসহ চেকপোস্টে রুবেলকে আটক করেছে পুলিশ। বিষয়নি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক অপপ্রচার চালানো হয়। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মামলার বাদী হলেও ইমরান নিজে অর্থ ব্যায় করে উকিল নিয়োগ করে রুবেলকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে সে ১৭ দিন কারাভোগ করে জামিনে বেরিয়ে আসে। রুবেল এখনো সেই ট্রমায় ভূগছে।
সাদিক এ্যাগ্রোর ইমরান বাংলাদেশ ডেইরী ফার্মার্স এসোসিয়েশনের মতো আলাদা সংগঠন করায় ১৬ খামারির বিরুদ্দে মামলা দেয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মধ্যরাতে খামারিদের বাসায় তল্লাশী চালানো হয়। বাড্ডার খামারী আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাঈদের যাত্রাবাড়ির বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে তার এক আত্মীয়কে তুলে নেওয়া হয়। একই মামলার আসামী বগুড়ার তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব নানা চাপে ইমরানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করায় তাকে পাশে বসিয়ে বিভিন্ন মেলা, অনুষ্ঠোনে নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ করা হয়নি উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদের হিসাব
সাঈদ আরও বলেন, খামারিদের একটি ফেসবুক গ্রুপ ছিল বিডিজিএইচ। গ্রুপে সাদিক এ্যাগ্রো নিয়ে নেগেটিভ মন্তব্য এপ্রুভ করায় গ্রুপটির এডমিন জেবরুলকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। ওই সময় সদ্য বিবাহিত ও এতিম জেবরুলকে ছাড়ানোর জন্য তার মা ও খালা সারারাত ইমরানের বাসার সামনের রাস্তায় বসে ছিল। কিন্তু তিনি (ইমরান) কোন সহযোগিতা করেননি। বরং বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘আমার তৈরি ব্লাক হোলে পড়ে গেছে। আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ গেলে তাকেও জেবরুলের পরিনতি ভোগ করতে হবে।’ এছাড়া রাসেল নামে এক খামারিকে প্রকাশ্যে মারধরের অভিযোগ তোলেন সাঈদ।
তিনি বলেন, ইমরানের পক্ষ নিয়ে কেউ কেউ খামারিদের এক হওয়ার ডাক দিয়েছে।
ইমরান গবাদী পশু বিক্রির আড়ালে একটি চোরা চালানোরসিন্ডিকেট ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। খাল দখল করে খামার করেছেন। পুলিশ ও সরকারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির সহযোগিতা পাওয়ায় ইমরান ছিলো বেপরোয়া।
পরিশোধ করেনি ব্রাহামার দাম:
কোরবানীর ঈদে কোটি টাকার গরু ও ১৫ লাখের ছাগল বিক্রিসহ সাদিক এ্যাগ্রোর ইমরানের নানামুখি প্রতারণা ও মিথ্যাচারের তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে সাদিক অ্যাগ্রোর একটি খামারে অভিযান চালায় দুদক। এ সময় দুদকের কর্মকর্তারা ওই খামারে আমদানি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদন নিষিদ্ধ সাতটি ব্রাহমা জাতের গরুর বাছুর ও পাঁচটি গাভির বিষয়ে তথ্য পায়। তার আগে দুদকের টিম সাভারের কেন্দ্রীয় গো–প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে অভিযান করে। সেখান থেকে গত রোজায় বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরানকে দেওয়া ১৫টি ব্রাহমা জাতের গরুর বেশ কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়। ওই নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় ইমরান ব্রাহামা জাতের গরুগুলো নিলও সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করেনি। তাছাড়া ইমরান গরুগুলো রমযান মাসে কেটে দুস্থদের মাঝে বিক্রি করার কথা ছিল সেটাও করেনি তারা।
অভিযানে অংশ নেওয়া দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘ইমরান সবগুলো বিষয় নিয়ে বাটপারি করেছেন। দুস্থদের কাছে গরু বিক্রির কথা থাকলেও তিনি সেটা করেননি। তিনি এতিম দুস্থদেরও হক মেরে খেয়েছেন।’
মোহাম্মদপুরে সাদিক এ্যাগ্রোতে ফের অভিযান
এদিকে দুদক আজ বুধবারও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এরাকায় সাদিক এ্যাগ্রোর খামারে অভিযান চালিয়ে যেসব গরু রোজার সময় কমদামে বিক্রির কথা বলে নিলামে ক্রয় করে সেগুলো জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে গরু ও বেশ কিছু নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে প্রাণী সম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে। সরকারের প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপট কাটিয়েএই প্রকল্প থেকে প্রাণী সম্পদ উন্নয়নে খামারীদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। প্রকল্প থেকে ডেইরী খাতে ২-৫টি গরু, ৬-৯টি গরু ও ১০-২০টি গরু তিন ক্যাটাগরিতে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। ইমরান এই খাত থেকে গত কয়েক বছর ধরে অর্থ সহায়তা নিয়েছেন। তিনি কত প্রনোদনা পেয়েছেন তার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত: গত কোরবানীর ঈদে সাদিক অ্যাগ্রো ‘বংশীয় গরু, খান্দানি ছাগল, গরুর বংশ পরিচয় আছে, গরুর ১১০ বছরের ব্ল্যাড লাইন আছে’ ইত্যাদি মিথ্যাচার করেন। প্রাণী সম্পদ মেলাতেও তিনি গরুর বংশপরিচয় বলে ভাইরাল হোন! ঈদের সময় তিনি বলেন, ‘গরুর দাম এক থেকে দেড় কোটি কারণ, এই গরুর ১১০ বছরের পেডেগ্রি আছে। গরুর বাপ, দাদা এবং পরদাদারা ছিলো ব্লাড লাইন চ্যাম্পিয়নের নোবেল সিরিজের গরু! এই গরুর দাঁড়ানোর স্টাইলও ভিন্ন! যার ফলে এটার দাম এক থেকে দেড় কোটি টাকা।’ তার খামার থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে মুফফিকুর রহমান ইফাত। সমালোচনার এক পর্যায় ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। গণমাধ্যমে আসতে থাকে মতিউর পরিবারের শত কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পদের কাহিনী।