শঙ্কা কাটছে: নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলগুলো

- প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে বিএনপি
- জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও এনসিপি গণঅধিকারসহ ৮টি ইসলামী দল নিয়ে জোট গঠন করছে
- তলে তলে অন্যান্য দলেরও প্রার্থী বাছাই চলছে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়তার কারণে ক্রমেই নির্বাচন মুখি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা নানা গুজব গুঞ্জনের বিভ্রান্তি কেটে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সব পক্ষই। দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক প্রশাসনিক সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচার সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্ন দাবিতে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অি নশ্চয়তা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা কেটে গেছে অনেকটাই। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির সাথে বৈঠক করে আগামী ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় নির্বাচনের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। গতকালও ৭ দলের সাথে বৈঠক করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করেছেন সেনাপ্রধান ও । তিনি স্পষ্টভাবে সরকারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফলে নির্বাচন নিয়ে সকল শঙ্কা কেটে গেছে বলেই সবাই মনে করে।
এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্ষপূর্তিতে ৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা জুলাই ঘোষণা ও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে তথা রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচনের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। এরপরই ধীরে ধীরে নির্বাচনের বিষয়টি পরিষ্কার হতে থাকে। এরপররই নির্বাচন কমিশনের সাথে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে একই ধরণের নির্দেশনা দেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন রাডম্যাপ ঘোষণা করার পরই হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী অস্থিরতা দেখা দেয়। সম্প্রতি রাজধানীর কাকরাইলে দুটি রাজনৈতিক দলের সহিংস ঘটনার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ময়দান। অনেকেরই ধারনা, এই পরিস্থিতিতে কোনভাবেই নির্বাচন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: কুড়িলে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টা গত রোববার বিএনপি জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির সাথে বৈঠক করে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন প্রতিজ্ঞ সময়েই নির্বাচন হবে। কেউ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে সরকার প্রতিরোধ করবে। নির্বাচন ছাড়া বিকল্প জনগন তথা জাতির জন্য বিপদজনক হবে। তিন দলের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ
ইউনুস বলেছেন, “নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। কেউ যদি নির্বাচনের কোনো বিকল্প ভাবে সেটা হবে এই জাতির জন্য গভীর বিপদজনক। তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর এ কথা জানিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা করেছেন সেই সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার বিষয়ে অগ্রগতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ প্রধান উপদেষ্টাকে এদিন অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছেন শফিকুল আলম। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন দুর্গাপূজাকে ঘিরে কেউ যেন কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
আরও পড়ুন: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনকে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত মনোনীত করলেন ট্রাম্প
পিআর পদ্ধতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব জানান ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হচ্ছে সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকের পর গণমাধ্যমে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সঠিক সময়েই নির্বাচন হবে এবং এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, তা আশ্বস্ত করতেই প্রধান উপদেষ্টা ডেকেছেন মির্জা ফখরুল বলেন, “নির্বাচন সঠিক সময়েই হবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। আমরা আমাদের মতামত পরিষ্কার করে বলেছি।
একই সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরু হক নূরের ওপর হামলার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপির এই নেতা। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে কোনোভাবে বিলম্বিত করার লক্ষ্যেই এই হামলা করা হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, সেটার বিষয়ে আমরা বলেছি যে এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে এবং এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি যে এটাকে খুব ভালোভাবে, গভীরভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। আমাদের আশঙ্কা নির্বাচনকে যে কোনোভাবে বিলম্বিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপিকে আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান মির্জা ফখরুল। এবং নির্ধারিত শিডিউলেই নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি।
জামায়াতের এক দাবী প্রসঙ্গে কথা বলতে যেয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, লন্ডনে একটি দলের সাথে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী, এমন প্রশ্নে তিনি জানান এটা একেবারেই অমূলক। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার অধিকার রয়েছে দেখা করার। তার নিজস্ব এখতিয়ারেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নেতার সাথে দেখা করেছেন। সেই বৈঠক ফলপ্রসু হওয়ায় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত বিএনপি সেটা অনেক আগে থেকেই জানা গেছে। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে আসছিল। সে ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচন মুখী কর্মতৎপরতাকে স্বাগত জানিয়েছে।
যেহেতু দেশের বড় আরেক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ সেমতে অপর রাজনৈতিক দল সমুহের মধ্যে জামায়াত ইসলামী, এনসিপি সহ অন্যন্য দলের মতামতও গুরুত্ব বহন করছে। এসকল দলের প্রায় সবই নির্বাচ- নমুখী কর্মকান্ড শুরু করে দিয়েছে বহু আগেই। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যে এরমধ্যে জামায়াত ইসলামী তাদের ৩০০ আসনের প্রার্থীই চূড়ান্ত করে গ্রীন সিগনাল দিয়ে রেখেছে। এবং ওই সকল প্রার্থীরা দেশের প্রতিটা আসনেই নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন। এরপরও জামায়াত নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি ছাড়া অংশ নেবে না, বা পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হবেনা এটা দলটির একটা রাজনৈতিক ষ্ট্যান্ডও হতে পারে। কেননা গত ১৬ বছর সুষ্ট ও নিরপেক্ষ এক নির্বাচনের দাবীতে জামায়াতও আন্দোলন করে এসেছে। এবং সেটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। ২৪ এর আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র চালাচ্ছে। ফলে এমুহুর্তে নির্বচনটা সুষ্ট ও উৎসব মুখর করার জন্য যেখানে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে জামায়াতের পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবী কতটা গ্রহনযোগ্য হবে সেটা সময় বলে দেবে। তবে রাজনীতির মাঠে অনেক দেনদরবারও থাকে। পিআর দাবী করা দল সমুহের তেমন কোনো দাবী আছে কি না সেটা এখনও ক্লিয়ার হচ্ছেনা।
জামায়াতের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সদ্য গঠিত এ রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করে এনসিপিকে সমার্থনে উদ্ধুদ্ধকরনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যা প্রকারান্তে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশবিশেষই মনে করা হয়। এটা ছাড়াও দলটির কোন কোন আসনে কে কে নির্বাচন করবেন সেটাও অনেকটা পরিষ্কার। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনেককেই তাদের নিজস্ব এলাকায় নির্বাচনী ওয়ার্ক ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। তারা ৫১ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী কাউন্সিল গঠন করেছে। এপফষপল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবার একই মঞ্চে আসতে আলোচনা চালাচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। দলগুলোর মধ্যে মতের ভিন্নতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও নির্বাচন লক্ষ্য করে ‘এক সাথে ভোট আনার’ স্লোগানও তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি ধর্মভিত্তিক দলের একমঞ্চে আসার চেষ্টা চলছে, তবে তাদের মধ্যে কোনো জোট হবে কি না তা দৃশ্যমান হবে তফসিল ঘোষণার পর।
যদিও দলগুলোর নেতারা বলছেন, জোট নয়, বরং নিজেদের মধ্যে নির্বাচনি সমঝোতা’ তৈরিতে আলোচনা হচ্ছে। এখনই নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন না তারা, শুরুতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি আদায়ে একসাথে সরব থাকতে চায় দলগুলো।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের গণমাধ্যমকে বলছেন, বিএনপি ছাড়া প্রধান সব দলই সংখ্যানুপাতিক ভোটের বিষয়ে একমত। আমরা চেষ্টা করছি, যারা (সংখ্যানুপাতিক ভোটের) পক্ষের তাদের অনেকের সাথেই আমরা আবার কথা বলছি।
ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলছেন, , “জোট হবে না। এটি নির্বাচনি সমঝোতা, আসন বিন্যাস। যার যেখানে যোগ্য প্রার্থী আছে আলাপ-আলোচনা করে সেখানে ওই দলের প্রার্থী থাকবে, অন্য দলের লোকেরা তাকে সমর্থন করবে।” ইসলামী দলগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনি সমঝোতা হওয়ার আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
যেহেতু এখনও নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষনা করেনি, এমনি মুহুর্তে রাজনৈতিক দল সমুহের যেসব কার্যকলাপ হওয়া উচিৎ সেটাই চলছে। তফসিল ঘোষনার পর পরই সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবেন নির্বাচনের দিকে। তাদের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষনা, প্রার্থী চূড়ান্ত করন ও ঘোষনা ইত্যাদি কাজে। আপাতত দৃষ্টিতে দেশ নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
ইসি যখনই তফসিল ঘোষনা করবে তখন নির্বাচন নিয়ে এখনকার যে বিতর্ক রয়েছে সেগুলো আর হালে পানি পাবেনা। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী একটি সুষ্ট নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে সব রকম সহায়তাদানের আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে সেনাবাহিনী প্রধান সে প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে আইনশৃংলাবাহিনীও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহন শুরু করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরে দেশের মানুষের যে ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। বিগত স্বৈরাচার সরকার, সেটা ফিরিয়ে দিতেই দৃঢ় বদ্ধপরিকর অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের মানুষও তার নিজের ভোট নিজে দিয়ে পছন্দের প্রার্থী বা নেতা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষার প্রহরগুনছে প্রতিনিয়ত।