এজেন্সি মালিক ও শ্রমিকদের জোরপূর্বক সাক্ষী নেওয়ার অভিযোগ

মালয়েশিয়ায় ১২ লাখ শ্রমিকের স্বপ্নভঙ্গের দায় সিআইডির মামলা

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৭:৩৯ অপরাহ্ন, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:৫৬ অপরাহ্ন, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি আদায় ও অর্থপাচারের অভিযোগ তুলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর সাম্প্রতিক মামলা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া এখন অনিশ্চয়তার মুখে।

শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এই মামলার কারণে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেক মালয়েশিয়ান কোম্পানি এখন বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে অনিচ্ছুক। তাদের আশঙ্কা, যদি সিআইডি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সনদপ্রাপ্ত (আইএলও, আইওএম, আরবিএ) এজেন্সিকে হয়রানি করতে পারে, তবে ভবিষ্যতে একই ধরনের পদক্ষেপ মালয়েশিয়ান কোম্পানিগুলোকেও সমস্যায় ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন: ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা: প্রস্তুত ২ হাজারের বেশি পুলিশ, সোয়াট টিম ও ডগ স্কোয়াড

আন্তর্জাতিক অডিটে যেকোনো অভিযোগ বা ভিত্তিহীন অভিযোগ, যাই হোক না কেন—তাদের ব্যবসা, পণ্য রপ্তানি ও বৈশ্বিক বাজারে সুনাম নষ্ট করতে পারে। এজন্য তারা আপাতত বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে বিরত থাকছে, যা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।

শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. সিবগাত উল্লাহ’র কাছে প্রশ্ন তুলেছেন—যে এজেন্সিগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বীকৃত, তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা কেন দাখিল করা হলো? অনেকের মতে, এটি নির্দিষ্ট স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাবে নেওয়া পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ১২শ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি

অভিযোগ রয়েছে, সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মনিরুজ্জামান রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের জোরপূর্বক সাদা কাগজে স্বাক্ষর করাতে চাপ দিচ্ছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এসব কাগজপত্র পরে মুচলেকা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো এজেন্সি মালিক স্বেচ্ছায় এমন কাগজে স্বাক্ষর করেননি।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এমপ্লয়ার পে মডিউল (মালিক কর্তৃক অভিবাসন ব্যয় বহন) চালুর মাধ্যমে শ্রমিকদের কোনো খরচ বহন করতে হয়নি। ইনস্টাইল সোফা এসডিএন বিএইচডি ও ন্যাশনগেট সল্যুশন এসডিএন বিএইচডি সহ একাধিক মালয়েশিয়ান কোম্পানির সহযোগিতায় ৪০০-এরও বেশি শ্রমিককে বিনা খরচে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।


সরকারি নীতির দ্বিচারিতা


সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আনুষ্ঠানিক খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ সিআইডি অভিযোগ করছে যে বেসরকারি এজেন্সিগুলো ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে—যা সরকারি নির্ধারিত ফির চেয়ে কম। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই বেসরকারি এজেন্সিগুলোর খরচ সরকারি এজেন্সি যেমন বোয়েসল-এর তুলনায় বেশি হয়। অথচ বোয়েসলকে বৈধভাবে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বেসরকারি এজেন্সিকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এই বৈপরীত্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একটি বেনামে অভিযোগ পেয়ে মানিলন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও মামলার পর তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ‘সাক্ষীর জবানবন্দি’ নামে একটি ফরম তৈরি করেছেন। যার সূত্র লেখা হয়েছে সিআই/ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম/ পা:পি:/ যাচাই-বাছাই ১০৬-২০২৪/১৪০২, তারিখ ৩-১২-২০২৪। ওই ফরমে কর্মকর্তা লিখেছেন ‘সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে আমরা কর্মী পাঠাতে পারিনি। ... এজেন্সি টাকা নিয়ে রশিদ দেয়নি। সিন্ডিকেট সদস্য পাসপোর্ট খরচ ১০ হাজার টাকা, কোভিড টেস্ট খরচ ১৭ হাজার টাকা, মেডিকেল খরচ ৬৫০০ টাকা ও পোশাক খরচ তিন হাজার টাকা থাকলেও কোনো টাকা খরচ করেনি। এটা আমার জবানবন্দি।’ একইভাবে সাক্ষীর বক্তব্য প্রধান সংক্রান্ত মুচলেকাসহ ফরম তৈরি করেছেন।

খোদ সিআইডির একজন ডিআইজির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য আইনে একই বক্তব্য লিখে ফরম তৈরির কোনো সুযোগ নেই। একেকজন ভিকটিম একেক রকম বক্তব্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নির্ধারিত বক্তব্য লিখে ফরম তৈরি করে সেটা জোরপূর্বক পূরণ করানো সাক্ষ্য আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন ও তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতার প্রমাণ বহন করে। তার এই প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

অভিযোগ রয়েছে, সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মনিরুজ্জামান রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের জোরপূর্বক সাদা কাগজে স্বাক্ষর করাতে চাপ দিচ্ছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এসব কাগজপত্র পরে মুচলেকা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো এজেন্সি মালিক স্বেচ্ছায় এমন কাগজে স্বাক্ষর করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। অথচ প্রমাণিতভাবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বীকৃত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে হয়রানি করা হলে শ্রমিক পাঠানোর গতি কমে যাবে। এতে শুধু রিক্রুটিং সেক্টর নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।