প্রশাসক হতে অব্যাহতি প্রাপ্ত এক উপসচিবের বিলাসী জীবনের নানা রহস্য

আটাবের সাবেক প্রশাসক মোতাকাব্বিরের বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৭:১৭ অপরাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৭:২২ অপরাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

মোতাকাব্বির আহমেদ (১৬০৪৭)-এর ভাগ্যে যেন সত্যিই আলাদিনের চেরাগ জুটেছে। ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, দুটি গাড়ি নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে চলেন। তিনি কখনও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কখনও ট্যুরিজম বোর্ড— সর্বত্রই তিনি পেয়েছেন আকাঙ্ক্ষিত ও সুবিধাজনক পোস্টিং। প্রশাসনে তাঁর অবস্থান এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন যে, ঘুষ ও প্রভাবের মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে ছিল হাতের মুঠোয়। কিন্তু সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (ATAB)-এর প্রশাসকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

গত চার আগস্ট সরকারি প্রজ্ঞাপনে তাকে আটাবের প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে চার মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য পাঠানো হয়। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। আটাবের প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি এয়ার টিকিট সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং সিন্ডিকেটদের পক্ষে অবস্থান নেন।

আরও পড়ুন: হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

প্রশাসক হিসেবে ২০২৫ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের একমুখী টিকিটের দাম ৪০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে এক লক্ষ টাকায় পৌঁছে যায়। অভিযোগ রয়েছে, এই অতিরিক্ত অর্থের অংশ মোতাকাব্বির নিজেও পেতেন। ট্রাভেল এজেন্সিদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কার্যক্রম না করে তিনি ট্রাভেল এজেন্সিদের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করেন। আটাবের প্রশাসকের দায়িত্বে এসে মোতাকাব্বির এয়ার টিকিট সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলানোর ফলে সৌদি আরবগামী গরিব শ্রমিক যাত্রীদের প্রতিটি টিকিটে অতিরিক্ত প্রায় ৬০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এই টাকা ভাগাভাগির একটি বড় অংশ মোতাকাব্বিরের নিকট বিভিন্ন সময়ে পৌঁছে দিত সিন্ডিকেট চক্র।

হঠাৎ আটাবের প্রশাসক মোতাকাব্বীর আহমেদকে ২২ তারিখে হঠাৎ প্রত্যাহার করা হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বিমান মন্ত্রণালয় ১৫ অক্টোবর মোতাকাব্বীর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলো, ফ্লাইট এক্সপার্ট, ফ্লাই ফার—দুটি ওটিএ টাকা পয়সা নিয়ে, অফিস বন্ধ করে গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে। এতে আটাবের প্রশাসক হিসেবে তিনি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং মন্ত্রণালয়কে কি অবহিত করেছেন, তা জানা যায়নি।

আরও পড়ুন: এবার জনগণই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে: সালাহউদ্দিন আহমদ

গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবের কক্ষে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়নকে কেন্দ্র করে হাতাহাতির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ জন উপসচিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম. এ. আকমল হোসেন আজাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি আটজনকে গুরুদণ্ড, চারজনকে লঘুদণ্ড ও পাঁচজনকে তিরস্কারের সুপারিশ করে। গুরুদণ্ড প্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন মোতাকাব্বির আহমেদও।

তবে অভিযোগ রয়েছে, মোতাকাব্বির বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করে সেই গুরুদণ্ড থেকে রেহাই পান। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে “ম্যানেজ” করার মধ্য দিয়েই তিনি প্রশাসনিক শাস্তি এড়াতে সক্ষম হন।

আওয়ামী সরকারের দোসর মোতাকাব্বির সর্বদা বেনিফিট পোস্টিংয়ে ছিলেন। সুযোগসন্ধানী মনোভাব ও কর্তাব্যক্তিদের তুষ্ট করাই ছিল তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এর জোন ৫-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবার পর আলাদিনের চেরাগ হাতে পান তিনি। মেয়র আতিকুলের ছত্রছায়ায় তিনি তার অবৈধ কর্মকান্ড ও উপার্জন চালিয়ে যান।

৫ ই আগস্টের পর সংস্কারপন্থী সেজে প্রশাসনে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন এই ছদ্মবেশী। একজন উপসচিবের মাসিক বেতন যেখানে ৬০ হাজার টাকা, সেখানে তাঁর বিলাসী জীবন যাপন প্রশাসনিক অঙ্গনে ঈর্ষণীয়। প্রমাণ পাওয়া যায়, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি স্ত্রী আফরোজ ফারজানা তুলি এবং দুই মেয়ে মেহজাবিন আহমেদ আফরা ও মাহবীন আহমেদ আকসাকে নিয়ে দুই দফা লন্ডন সফরে যান। বিমান ভাড়া, হোটেল, সাইট-সিইং ও অন্যান্য খরচসহ প্রতিটি ট্রিপে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। দুই ট্রিপে সর্বমোট খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা।

মোতাকাব্বিরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে— তিনি লন্ডনে অবৈধ অর্থ পাচার করে ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন এবং তাঁর পরিবারকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। ATAB-এর নির্বাচনের জন্য সরকার তাঁকে চার মাসের সময় দিলেও প্রায় আড়াই মাস পার হয়ে গেলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। এটি ছিল তাঁর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ— এয়ার টিকিটের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা এবং সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় থাকা।

একাকারনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে তাঁকে ATAB প্রশাসকের পদ থেকে প্রত্যাহার করেছে।

মোতাকাব্বিরের প্রশাসনিক অনিয়ম, ঘুষ, সিন্ডিকেটের আশ্রয় ও বিলাসী জীবনের পেছনের রহস্য সরকারের কড়া বিচারে আনার দাবী এখন সকলের।