পবিত্র আশুরা ও কারবালার শিক্ষনীয় ঘটনা

মুসলিম ইতিহাসে পবিত্র আশুরা ও কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডি দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় হলেও একই দিবসের কারণে বেশিরভাগই একই রকম মনে করে। মানব সৃষ্টির আগে থেকেই আশুরার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।মুসলমানদের জন্য এটি ঐতিহাসিক দিন। রাসুল (সাঃ) এর আবির্ভাবের বহু আগে থেকে সমাজের গুরুত্ব বিদ্যমান ছিল। আর কারবালার ঘটনা আমাদের কাছে খুবই মর্মান্তিক শোকাবহ দিন। কিন্তু পবিত্র আশুরার অপরিমেয় ফজিলতপূর্ণ আমলের পরিবর্তে কারবালার ঘটনাকে পুঁজি করে আমাদের সমাজে নানা ফিতনা ফাসাদে আমরা জড়িয়ে পড়ছি। পবিত্র কুরআন-হাদিস ও ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে আমরা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।
আশুরা দিবসের ইতিহাস
আরও পড়ুন: নুসুক অ্যাপ এখন থেকে ইন্টারনেট ছাড়াই ব্যবহার করা যাবে
কারবালায় ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির বহু পূর্ব থেকেই আশুরার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। এ দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়, হজরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া, হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন, তাঁর শত্রু ফেরাউনের নীল নদে ভরাডুবি হয়। এই দিনে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগ থেকে মুক্তি পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) তার প্রিয় পুত্রকে ফিরে পান। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে দজলা নদীতে বের হয়েছিলেন এই দিনে। হজরত সুলাইমান (আ.) এই দিনে পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়া হয় এই দিনেই। হজরত জিব্রাইল (আ.) সর্বপ্রথম আল্লাহর রহমত নিয়ে রসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করেছিলেন। মহররমের কোনো এক শুক্রবার ইস্রাফিল (আ.)-এর সিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস হবে। নবীজির ইন্তেকালের কয়েক দশক পর ৬০ হিজরি সালে এ দিনেই প্রিয় নবীর (সা.) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্বপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম বর্বর হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে ইয়াজিদের পিশাচ বাহিনী। কারবালার ঘটনা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম এক ঘটনা। এ ঘটনা আমাদের শেখায় হকের পক্ষে অবিচল থাকার, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এবং জালিমের সামনে মাথা নত না করার শিক্ষা। তবে ইসলামে আশুরার মাহাত্ম্য কেবল এ কারণে নয়।
কারবালা প্রান্তরের ইতিহাস
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিল শুরু
মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ২০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ৬০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে মজলিশে শুরা ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। তার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খেলাফতের দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের কিছু এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মাদিনার অধিকাংশ মানুষ, ইরাকের অনেকে বিশেষ করে কুফার জনগণ তা মানতে অস্বীকার করেন। কুফার জনগণ নবী-দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কুফার লক্ষাধিক মানুষ ইমাম হোসাইনকে খলিফা হিসেবে বাইয়াতপত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রে তারা দাবি করেন, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তার দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিরা এবং ইমাম হোসাইনের নিকটাত্মীয়রা ইমামকে কুফায় যেতে বারণ করেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসী ইমাম হোসাইনের পক্ষ ত্যাগ করবে।
এমতাবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে ইরাকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন। তাকে তিনি এই নির্দেশ প্রদান করেন যে, যদি সে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে এবং ইরাকবাসীদের অন্তরকে সুদৃঢ় ও সুসংহত পায় তাহলে যেন তার কাছে দূত প্রেরণ করে। মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় আগমন করার সাথে সাথে ১৮ হাজার কুফাবাসী তার কাছে এসে ইমাম হোসাইনের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে। এবং তারা শপথ করে বলে, অবশ্যই আমরা জানমাল দিয়ে ইমাম হোসাইনকে সাহায্য করবো। তখন মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হোসাইন (রা.) এর নিকট পত্র পাঠিয়ে জানালেন যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক, তিনি যেন আগমন করেন। এই সংবাদের ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। এই খবর ইয়াজিদের নিকটে পৌঁছালে কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশির (রা.)-কে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার গভর্নরের দায়িত্ব প্রদান করেন। এবং তাকে এই মর্মে নির্দেশ দেন, ইমাম হোসাইন (রা.) যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে। ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ কুফায় পৌঁছে সেখানকার জনগণকে কঠোর হস্তে দমন করে এবং মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে। এরপর ইমাম হোসাইন (রা.) কে প্রতিরোধ করতে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে। ইবনে জিয়াদের বাহিনী কারবালার প্রান্তরে অবরোধ করলে হোসাইন (রা.) বললেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসিনি। তোমরা আমাকে ডেকেছো বলে আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত পরিত্যাগ করছ। তাহলে আমাদেরকে যেতে দাও, আমরা মদিনার ফিরে যাই অথবা সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি অথবা সরাসরি ইয়াজিদের কাছে গিয়ে তার সাথে বোঝাপড়া করি। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেয়। ইমাম হোসাইন (রা.) ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন।
অতঃপর আশুরার দিন (১০ মহররম) সকাল থেকে ইবনে জিয়াদের বাহিনী হোসাইন (রা.) এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং ফোরাত নদী থেকে পানি সংগ্রহের সকল পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা.) এর শিবিরে শুরু হয় পানির জন্য হাহাকার। হোসাইন (রা.) বাতিলের কাছে মাথা নত না করে সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ পুরুষ সাথীরা সবাই একে একে শাহাদাতের অমিয়সুধা পান করেন। মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম হোসাইন একাই বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়। সিনান বা শিমার নামক এক পাপিষ্ঠ তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.) এর ছিন্ন মাথা বর্শার ফলকে বিদ্ধ করে এবং তার পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে দামেশকে ইয়াজিদের নিকট প্রেরণ করা হয়। ইমাম হোসাইন (রা.) এর কর্তিত মাথা দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পরে এবং বাহ্যিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আমি তো ইমাম হোসাইনকে শুধু কুফায় প্রবেশে বাধা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেইনি। এরপর তার পরিবার-পরিজনকে স্বসম্মানে মদিনায় প্রেরণ করা হয়। (সূত্র : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। ইয়াজিদের বাহিনী কারবালা প্রান্তরে জয়লাভ করলেও তারা মূলত পরাজিত হয়। ইতিহাস সাক্ষীÑ ইমাম হোসাইন ও তার সাথীদের হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদ মৃত্যুবরণ করে এবং তার পুত্রেরও কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয়। এরপর আর কোনো দিন তার বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি।
কারবালার প্রান্তরে মহানবীর (সা.) দৌহিত্র হজরত হোসাইনকে (রা.) মর্মান্তিকভাবে শহীদ করার ঘটনা সত্যিই প্রতিটি মুমিনের গা শিউরে ওঠার মতো। এ রক্তক্ষয়ী বেদনাবিধুর হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিম জাতির সর্বাধিক বিয়োগান্তুক ট্র্যাজেডির অন্যতম। বিশ্ব মুসলিমের কাছে ঐতিহ্যমণ্ডিত আশুরার দিনে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল পবিত্রতাকে কলুষিত করতে। কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের শিমারের খঞ্জর হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিরোচ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত্ব আর মহানুবতাকে হত্যা করতে পারেনি। বরং হক-বাতিলের আমৃত্যু লড়াই অব্যাহত রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে কারবালার এ মর্মস্পর্শী ঘটনা। ত্যাগ ও তিতিক্ষার নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নবী দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)। সেদিন হকেরই বিজয় হয়েছিল। ফলে ইতিহাসের সোনালি পাতায় ইমাম হোসাইন (রা.) আজও বেঁচে আছেন আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ