বিবিসির বিশ্লেষণ
বিডিআর তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জমার পর এখন কী হবে?
বিডিআর সদরদপ্তরে হত্যাকাণ্ডের মামলা যখন বিচারে চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ঘটনার ১৬ বছর পরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে নতুন করে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে।
এই কমিশনের প্রতিবেদনে, বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে 'দলগতভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত' এবং 'মূল সমন্বয়কারী ফজলে নূর তাপস' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: তফসিল ও ভোটের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর আহ্বান ইসির
গত রোববার এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে কমিশন।
পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'গ্রিন সিগন্যাল' ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন: চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করলেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে খালেদা জিয়াকে: মির্জা ফখরুল
একইসাথে, ওই ঘটনার সাথে 'ভারতের জড়িত থাকার' কথাও তুলে ধরেছে কমিশন।
বিবিসি বাংলাকে কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, প্রতিবেদনটি কমিশনের কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ নেই। তারা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন সেটি। আগামী রোববার এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে সেটি পাওয়া যেতে পারে।
এদিকে, ওই ঘটনায় পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুইটি তদন্ত কমিটি হয়েছিলো।
এর একটিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। মি. আলমের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও ফোন রিসিভ করেননি।
ওই সময় দুইটি মামলার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাটি বর্তমানে বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেটি সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আরেকটি যেটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা সেটি এখনো বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
এসব মামলায় এখন পর্যন্ত বিডিআরে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে বলে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে যেসব প্রশ্ন
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে ২৩শে ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে এই জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের কথা জানা যায়। গত ৩০শে নভেম্বর, রোববার প্রতিবেদনও জমা দেয় কমিশন।
অর্থাৎ ১১ মাস এক সপ্তাহের মধ্যেই এই কমিশন তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এই কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কমিশনের ওয়েবসাইটে এক গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, "বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও প্রকৃত ঘটনার স্বরূপ উদঘাটন, ঘটনায় রুজুকৃত দুটি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত, ঘটনার ষড়যন্ত্রকারী, ঘটনার সহযোগী, ঘটনার আলামত ধ্বংসকারী, সংঘটনকারী এবং অপরাপর সংশ্লিষ্ট বিষয় ও অপরাধীদের এবং সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, বিভাগ, সংগঠন চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে" এই কমিশন গঠন করা হয়েছে।
ফলে এখন অনেকেই আসলে প্রশ্ন তুলছেন যে এই স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের পরে আসলে ঠিক কী হবে? এটার গুরুত্বই বা কী?
আবার আপিল বিভাগে মামলার শুনানিতে এই প্রতিবেদন আমলে নেওয়া হবে কি না সেটিও ভাবছেন কেউ।
একইসাথে এই প্রতিবেদনে নতুন করে যাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা করার সুযোগ রয়েছে কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে।
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ভিন্নমত দিয়েছেন।
আইনজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, বিচারের ব্যাপারে এই তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের কোনো মূল্য নেই। কেননা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আবার কোনো কোনো আইনজীবী সংশয় প্রকাশ করেছেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশ হলে বিচারাধীন মামলায় আসামিরা তা উপস্থাপন করলে খালাস পেতে পারেন।
আদালতে প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, কোনো ঘটনার পর ইনকোয়ারি অ্যাক্টের অধীনে এই ধরনের তদন্ত কমিশন গঠিত হয়।
মূলত ভবিষ্যতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এবং যে গাফিলতি বা ভুলের জন্য ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে সরকার যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে সে কারণেই এই ধরনের তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। তিনি আরো মনে করেন, ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করার এখতিয়ার কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
মি. মালিক বলছেন, "ফৌজদারি ব্যাপারে যেখানে অপরাধ হয়েছে, অপরাধের ব্যাপারে তদন্ত করার ক্ষমতা একমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা তদন্ত করে কিছু পেলে সাক্ষ্য-প্রমাণ হলে কোর্টে আমলে নেবে"।
"এই রকম ঘটনা ঘটলে এর কারণ কী এবং ভবিষ্যতে যাতে ওইগুলো আর না হয় তার জন্য করণীয় নির্দেশ করতে পারে তদন্ত কমিশন। বিডিআর মামলার বিচারের সাথে এর সাথে কোনো সম্পর্ক নাই," মনে করেন তিনি।
এই ঘটনায় করা হত্যা মামলাটি বিচারের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কারণ বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের বিচার শেষে এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলাটি।
তাই ওই মামলার বিচারের ব্যাপারে তদন্ত কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনের কোনো মূল্য নেই বলেও জানান তিনি।
যদিও সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত হওয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
মি. মোরসেদ বলছেন, পিলখানায় 'ডাল-ভাত কর্মসূচি' নামক বিডিআর বিদ্রোহের ঘটেছে এমন বিবেচনায় ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হত্যা মামলাটির বিচার হয়েছে।
এই তদন্ত প্রতিবেদনে বিডিআরে বিদ্রোহ নয় বরং ভারতের সহযোগিতায় ঘটনা ঘটার কথা বলা হয়েছে যা সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন তিনি।
ফলে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।
"যে বিচারটা হয়েছে সেই বিচারটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এই তদন্ত প্রতিবেদন এবং সেখানে ওই আসামিরা বেনিফিট অব ডাউটের কারণে সবাই খালাস হয়ে যেতে পারে। এর মাধ্যমে ৫৪ জন সামরিক অফিসারের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এই সমস্যাগুলো হবে," শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন মি. মোরসেদ।
"আর যদি প্রতিবেদন প্রকাশিত না হয় তখন আমরা মনে করবো একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে শুধু মিডিয়া ক্যাম্পেইন করার জন্য," বলেন তিনি।
নতুন করে আবার মামলার প্রশ্ন আসতে পারে কি না জানতে চাইলে এই আইনজীবী জানান, "এই মামলা একবার হয়ে গেছে। চূড়ান্তভাবে বিচারের জন্য আপিল বিভাগে আছে। সেখানে নতুন করে আবার মামলা করার সুযোগ নেই। এক বিষয়ে তো দু্ই মামলা হয় না। যদিও করে সেই মামলাও আইনের প্রশ্নের মুখে পড়বে।"
তবে শুধু সরকারপক্ষ যদি এই প্রতিবেদন নিয়ে আদালতে কোনো আবেদন করে সেক্ষেত্রে তা বিবেচনা করতে পারে সর্বোচ্চ আদালত।তদন্ত কমিশন যা বলছে
রোববার তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। মঙ্গলবার থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের কয়েকটি পাতা ঘুরতে দেখা যায়।
তবে এই পাতাগুলো আদৌ প্রতিবেদনের কপি কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এই পাতায় বিডিআর ঘটনার সময় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এমন বেশ কিছু কর্মকর্তার নাম দেখা যায়।
এদের মধ্যে পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমের নামও রয়েছে। ঘটনার সময় তিনি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এসবির অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সত্যতা জানতে মি. আলমের মোবাইলে ফোন করলে রিসিভ করেননি তিনি।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি এই জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান।
বিবিসি বাংলা তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ে সেটি পাবলিক করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, কমিশনের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
মি. রহমান বলেন, "এই সপ্তাহটা যাক। এই পর্যন্ত আমরা কমিশনে আছি। আমরা কমিশনে থাকবো আগামী রোববার পর্যন্ত, তারপরে। পাবলিক মানে আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা করে দিয়েছি"।
অর্থাৎ আগামী রোববার পর্যন্ত এই কমিশনের মেয়াদ রয়েছে।
তিনি জানান, এরপরে মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু কমিশনের কাছ থেকে এই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে না।
একইসাথে এই প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা কতখানি কার্যকর করা যাবে এমন প্রশ্নে মি. রহমান বলেন, "বিডিআর সৈনিক যাদের বিচার ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্টে আছে, ওই সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে পারবো না। ওইটা আমাদের ইনভেস্টিগশনের বাইরে ছিল"।
তবে, বিচারে ব্যবহৃত সাক্ষ্য, নথি ও তথ্য-প্রমাণাদি এই কমিশন বিবেচনা করেছে কি না এমন প্রশ্নেরও উত্তর দেন তিনি।
"আমলে তো নিয়েছি আমরা। আমাদের সত্য বের করার জন্য আমলে নিয়েছি। কিন্তু ওদের বিষয়টা আমরা উহ্য রেখেছি। কারণটা হলো আমাদের যে প্রজ্ঞাপন ছিল, ওখানেই বলে দেওয়া হয়েছে যে বিচারাধীন বিষয় সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে পারবো না," বলেন মি. রহমান।
বিডিআরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারত জড়িত কীভাবে–– এমন প্রশ্নের উত্তর প্রথমে দিতে চাননি তিনি। পরে আবার নিজেই ফোন করে জানান, "ভারত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এই কথা আপনি বলতে পারেন, কারণ হলো সংবাদ সম্মেলনে আমরা এই কথা বলেছি।"
তিনি আরো বলেন, "৯২১ জন ভারতীয় ওই সময়টাতে এসছিলো বাংলাদেশে। তার মধ্যে একটি হিসাবে ৬৫ জন, আরেকটি হিসাবে ৬৭ জন দেখা যাচ্ছে যে তারা বিমানে এসেছে, কিন্তু বিমানে ফিরে যায়নি, আবার বাইল্যান্ডে এসেছে, আবার ওইদিক দিয়ে ফিরে যায়নি। এই স্ট্যাটিসটিকসগুলো আমরা পেয়েছি।"
তবে এই ব্যক্তিরা পিলখানার ঘটনায় জড়িত কি না বা কীভাবে জড়িত, এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন বলে জানান মি. রহমান।
"এইটা বলা খুব মুশকিল। কারণটা হলো যে, এটা সন্দেহের উদ্রেক করে। বিকজ এই লোকগুলো এসে আর ফিরে যায়নি। যেই চ্যানেলে এসছিলো সেই চ্যানেলে তারা আর ফিরে যায়নি। আমাদের কাছে তাদের ফুল ডকুমেন্ট আছে, নামসহ পাসপোর্ট নম্বর একেবারে এভরিথিং," বলেন জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।
এই ঘটনায় হত্যা মামলার আসামি ছিল ৮৫০ জন; অপরদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলাটিতে ৮৩৪ জনকে আসামি করা হয়।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ১৫২ জনকে। পরে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশে এটাই প্রথম মামলা যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসামি এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে রায়ের পর আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন।
ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এসে ১৬ বছর পর এ বছরের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো এই মামলার প্রায় আড়াইশো আসামিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় জামিন দেয় আদালত।
সূত্র: বিবিসি





