সাক্ষী বিড়ম্বনায় পুলিশ

Sadek Ali
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১:১৫ অপরাহ্ন, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২:২৯ অপরাহ্ন, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে দেশের অসংখ্য পুলিশ সদস্য প্রতিদিন এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন। আর সেই অস্বস্তিকর বাস্তবতাটা হল- পুরনো মামলায় সাক্ষ্য দিতে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হওয়া। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট জমা দেওয়ার বহু বছর পরও পুলিশ সদস্যদের সাক্ষী তালিকায় থাকতে হয়, যা বদলি, প্রশাসনিক চাপ, জনবল সংকট ও ব্যক্তিগত জীবনের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। আদালতের তলব, দীর্ঘ ভ্রমণ, কর্মঘণ্টা ব্যয় এবং আমলাতান্ত্রিক অনিশ্চয়তা- এসব মিলিয়ে এই ‘সাক্ষীর ঝামেলা’ আজ পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি কাঠামোগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সারা দেশে বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়ার মামলাগুলোতে নাগরিকদের পাশাপাশি সাক্ষীর তালিকায় থাকেন পুলিশ সদস্যরাও। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবেও পুলিশ সদস্যদের আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হয়। কিন্তু আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়ার পর অনেক মামলায় পুলিশ সদস্যরা আর সাক্ষ্য দিতে চান না। অনেকেরই দূরবর্তী কোনও জায়গায় বদলি হওয়ার কারণে এ ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু যথাযথ সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলায় বিচার সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।  এদিকে যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ সদস্য সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। সকাল থেকে থানার কাজ পরিচালনা করার পর, একজন পুলিশ অফিসার হঠাৎ বিকেলে আদালতের নোটিশ পান। দশ বছর আগে দায়ের করা একটি মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাকে তলব করা হয়। তবে, সেই মামলাটি ঢাকায় দায়ের করা হয়েছিল এবং বর্তমানে তিনি ঢাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত জেলা শহর কক্সবাজারে কর্মরত। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাকে পরের দিনই ঢাকায় উপস্থিত হতে হবে। তিনি কী করবেন? এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের শত শত পুলিশ সদস্যের জন্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা। এক দশক বা তার বেশি পুরনো মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হলে তাদের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে এক অদৃশ্য চাপ তৈরি হয়, যাকে অনেকে ‘সাক্ষীর ঝামেলা’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে - কখনও কখনও ৮ বছর, কখনও কখনও এমনকি ১৫ বছর। এই সময়ের মধ্যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা বা বাদী পুলিশ কর্মকর্তাকে একাধিকবার বদলি করা হয়। কিন্তু যখন আদালত মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া শুরু করে, তখন সেই একই পুরনো কর্মকর্তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তলব করা হয়।

আরও পড়ুন: প্রথমবার বাংলাদেশে তৈরি হবে রপ্তানীমুখী ড্রোন, জমি নিতে বেপজার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন

শাহবাগ থানার ২০১৫ সালের একটি মামলার বাদী ছিলেন একজন পুলিশ পরিদর্শক, যিনি বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত। দশ বছর পর, যখন বিচার শুরু হয়, তখন আদালতের আদেশে তাকে ঢাকায় ফিরে এসে সাক্ষ্য দিতে হয়। দীর্ঘ যাত্রা, সময়ের অপচয় এবং আমলাতান্ত্রিক অনুমোদন - জটিলতাগুলো সীমাহীন। একজন কর্মকর্তাকে প্রায়শই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুই থেকে তিন দিন সময় আলাদা করে রাখতে হয়। ভ্রমণ, আদালতে উপস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এটি থানার নিয়মিত কাজ ব্যাহত করে, জনসেবা ধীর করে দেয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিশেষ শাখার (ডিএসবি) একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক সময় আমরা ভিন্ন জেলায় ডিউটিতে থাকি, কিন্তু পুরনো মামলার কারণে একই দিনে আমাদের দুটি জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটি অফিসের কাজের ক্ষতি করে এবং মানসিক চাপ বাড়ায়।’ পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি, সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে এই জটিলতা অফিসারদের ব্যক্তিগত জীবনকেও প্রভাবিত করে। অনেককে দীর্ঘ ভ্রমণ করতে হয়, তাদের পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় এবং কখনও কখনও তাদের সাক্ষ্যের জন্য আদালতে সারাদিন অপেক্ষা করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন সাক্ষ্য দিতে যাই, তখন কখনও কখনও আমাদের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকতে হয়, কেবল সেই দিন মামলার শুনানি স্থগিত রাখার জন্য। ফলস্বরূপ, পুরো দিনটি নষ্ট হয়, কিন্তু গঠনমূলক কিছুই অর্জন করা হয় না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যখন পুলিশ সদস্যরা পূর্ববর্তী থানা থেকে কোনও মামলায় সাক্ষ্য দিতে যান, তখন তাদের ভ্রমণ বা থাকার ব্যবস্থার কোনও দায়িত্ব রাষ্ট্রের থাকে না। তাদের সবকিছু নিজেরাই পরিচালনা করতে হয়। তারা নিজেরাই সমস্ত খরচ বহন করে, যা পরে রাষ্ট্র বিল আকারে পরিশোধ করে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রকৃত খরচের চেয়ে কম। তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হয়, তাই তারা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে ভোগেন।’ কর্মকর্তা পরামর্শ দেন যে, কর্মক্ষেত্র বা আদালত কর্তৃক সাক্ষ্য ব্যয়ের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করা হলে এবং স্থানীয় পুলিশের তত্ত্বাবধানে আদালত সংলগ্ন এলাকায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হলে, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মীদের জন্য যেখানে পরিস্থিতি আরও জটিল, জটিলতা হ্রাস পাবে।

আরও পড়ুন: মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে যা হচ্ছে

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী এবং হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এর সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে ফৌজদারি মামলায় পুলিশ সাক্ষী এবং তাদের জেরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু মামলার সংখ্যা আমাদের পুলিশ সদস্যের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। আপনি দেখতে পাবেন যে ঢাকায় দুই বছর ধরে কাজ করা প্রতিটি পুলিশ কর্মকর্তা কমপক্ষে ২০০টি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হতেন। এখন, যদি তাদের অন্যত্র বদলি করা হয়, তাহলে সেই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাদের ২০০ বার ঢাকায় আসতে হবে। যদি এটি চলতে থাকে, তাহলে তাদের জন্য তাদের চাকরি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’ তিনি পরামর্শ দেন যে, এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হলে প্রথমে মামলার জট কমাতে হবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পুলিশের উপর তদন্তের বোঝাও বেশি। তাই, পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়িয়ে তদন্তের চাপ কমাতে হবে। অধিকন্তু, উন্নত তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে, ডিজিটাল সাক্ষী সক্ষম করলে পুলিশের জন্য সাক্ষীর ঝামেলা কমাতে সাহায্য করতে পারে, যদিও আইনি জটিলতা থাকতে পারে। এর কারণ হল সাক্ষীর সাথে প্রাসঙ্গিক নথিপত্র থাকা প্রয়োজন। যদি তাদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়, তাহলে তাদের কাছে এই জিনিসপত্র থাকবে না। তবে, যদি পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং সরকারি আইনজীবী (জিপি) অফিসগুলি আগে থেকে এই নথিপত্রগুলি সরবরাহ করতে পারে, তাহলে এটি লাভজনক হবে। এটি করার জন্য, আদালতের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর ছাত্র ও জনসাধারণের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ পুলিশে প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই, পুলিশ সংস্কার কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এখন ডিজিটাল সাক্ষ্যদান ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সময়। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রদান করা হলে, অফিসারদের আর তাদের পুরনো থানায় ফিরে যেতে হবে না। 

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘প্রযুক্তির যুগে, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা আর সময়োপযোগী নয়। ডিজিটাল সাক্ষ্যদান ব্যবস্থা বাস্তবায়ন বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে এবং পুলিশের কর্মক্ষম দক্ষতা বজায় রাখবে।’

ডিজিটাল সাক্ষ্য ব্যবস্থা চালু হলে কর্মকর্তাদের যাতায়াত খরচ, সময় এবং প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস পাবে। তারা তাদের কর্মস্থলে অবস্থানকালে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ভিডিও সাক্ষ্য প্রদান করতে সক্ষম হবেন। এটি মামলার শুনানি ত্বরান্বিত করবে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ করবে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করা একজন সিনিয়র সাংবাদিক (অপরাধ বিশ্লেষক) মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ সদস্যরা সামনের সারিতে কাজ করেন। তাদের সাক্ষ্য আদালতের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু যদি সেই সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে তাদের কর্মজীবন ব্যাহত হয়, তাহলে ব্যবস্থার পর্যালোচনা অপরিহার্য।’

বাংলাদেশ যখন পুলিশ সংস্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ‘সাক্ষীর ঝামেলা’ সমস্যার একটি আধুনিক সমাধান কেবল সময়ের প্রয়োজনই নয়, বরং একটি দক্ষ ও প্রযুক্তি-সক্ষম বিচার ব্যবস্থার পূর্বশর্তও বটে।