বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

Any Akter
এম. এ. মাতিন
প্রকাশিত: ৩:৫৩ অপরাহ্ন, ১৬ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ৫:১১ অপরাহ্ন, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হলেও, বর্তমানে বাজার অর্থনীতি মারাত্মক চাপে রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত দুর্বলতা— এসব মিলিয়ে দেশের বাজার ব্যবস্থায় এক অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি এই অর্থনৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার।

আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি

১. সংকটমুখর এক অর্থনৈতিক যুগঃ-

বাংলাদেশ বিগত বছর গুলির অর্থনৈতিক সাফল্যগাঁথা হয়ে উঠলেও, এখনকার বাজার অর্থনীতি গভীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বৈদেশিক রিজার্ভে অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতির ঘোরাল ওঠা-নামা, বিনিয়োগে সংকোচ—এসব সংকেত দিচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক মডেল পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়

২. প্রতিবেশের মুখে সঙ্কটের চিত্রঃ-

 (ক) মূল্যস্ফীতি (CPI–বছরের ভিত্তিতে)

জুন ২০২৫ সালে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮%, যা মে’তে ছিল ৯.০৫% এবং জুন ২০২৪-এ ছিল ৯.৭২%   ।

এ ডেটা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং IMF এর প্রতিবেদন থেকেও নিশ্চিত হয়েছে (২০২৫-এ বার্ষিক গড় ~১০%, সংস্করণে ২০২৬ এর মাঝামাঝি ~৫%)  ।

 (খ) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

জুন ২০২৫ পর্যন্ত মোট বৈদেশিক রিজার্ভ: $31.77 বিলিয়ন (BPM6 অনুযায়ী $26.74 বিলিয়ন)  ।

মার্চ ২০২৫–এ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে $25.44 বিলিয়ন, যা ACU বিনিময়ের ফলে সাময়িকভাবে $20.29 বিলিয়নে নেমে যায়  ।

GDP-র বড় অংশ হিসাবে, রিজার্ভ ছিল ৪%, যা দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে নিচ স্তর  ।

(গ) রেমিট্যান্স প্রবাহ

মার্চ ২০২৫ মাসে রেকর্ড $3.29 বিলিয়ন রেমিট্যান্স প্রবেশ করেছে  ।

২০২3 এ বাংলাদেশ প্রায় $23 বিলিয়ন রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা উপার্জনের বড় উৎস   ।

 (ঘ) FDI প্রবাহ

সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ FDI প্রবাহ: $300 মিলিয়ন, যা আগের কোর্টার $949 মিলিয়নের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম  ।

৩. বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র: সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষনঃ-

চ্যালেঞ্জ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ

মূল্যস্ফীতি~৮.৪৮–৯.০৫% (জুন–মে) খাদ্য, শক্তি ও কোর-ইনফ্লেশনের সম্মিলিত প্রভাব—জনজীবনে চাপ

রিজার্ভ BPM6 অনুযায়ী $26–31 B; GDP এর ৪% মার্জিন কম, বৈদেশিক লেনদেনে চাপ

রেমিট্যান্স মাসিক $3.29 B (মার্চ) রেমিট রিপ্লেসমেন্ট, তবে খরচ বৃদ্দি চ্যালেঞ্জিং

FDI পর্ব নির্দিষ্ট $300 M বিনিয়োগে আস্থা পতন, সঙ্কটের কারণ

মুদ্রানীতি লিবারালাইজড রেট (মে ১৪); ব্যাংক সতর্কতা দর-কষাকষি হ্রাসে এই পদক্ষেপ সহায়ক, তবে রিজার্ভ স্থিতিশীলতা জরুরি

বাজার অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা: চিত্রটা কেমন?

১. অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিঃ-

ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI) বেড়েই চলেছে; নিত্যপণ্যের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

চাল, ডাল, তেল, সবজি থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সব কিছুর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন—‘উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কিন্তু চাহিদা কমেছে’।

২. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটঃ-

রিজার্ভ কমে এসেছে ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে (জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত অনুমিত তথ্য ভিত্তিতে)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজার সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা টেকসই হচ্ছে না।

রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) প্রত্যাশার তুলনায় কমছে।

৩. টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের দামঃ-

এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য ১০–১২% পর্যন্ত বেড়েছে।

এর ফলে আমদানি নির্ভর সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, বিশেষ করে জ্বালানি, কাঁচামাল ও ওষুধ।

৪. বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক আস্থা হ্রাসঃ-

রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও নীতির অস্বচ্ছতা ব্যবসায়িক পরিবেশকে নষ্ট করছে।

বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) কমেছে, দেশীয় উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প হাতে নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো?

* নীতিগত দুর্বলতা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট।

রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রানীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব।

* রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা

নির্বাচনের পরবর্তী সময়েও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হওয়ায় বাজারে ‘অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তা’র মনোভাব।

* দুর্নীতি ও লুটপাট

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আর্থিক খাত জর্জরিত।

এক শ্রেণির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বাজারব্যবস্থাকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে—লাভ নিচ্ছে সিন্ডিকেট, ভুগছে জনগণ।

* আন্তর্জাতিক প্রভাব

বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতার ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে।

বৈশ্বিক মুদ্রানীতি কড়াকড়ির কারণে রপ্তানিমুখী দেশগুলোতে প্রতিযোগিতা বেড়েছে—বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।

পলিসি গ্যাপ: সরকারের দায় ও ব্যর্থতাঃ-

সরকার সংকট মোকাবেলায় নানা ধরনের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নে আছে দারুণ ব্যর্থতা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো বাজার তদারকি নেই।

একের পর এক ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার, কিন্তু তাতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে।

রপ্তানিখাতে উদ্ভাবনী ও বহুমুখীকরণ নেই—এখনো পোশাকশিল্প নির্ভরতা প্রবল।

ব্যাংকিং খাত সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।

করণীয়: এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়ঃ-

বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে যে পদক্ষেপগুলো জরুরি:—

৫.সংকটের মূল কারণসমূহঃ-

১. নীতি ও প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক-অর্থমন্ত্রীর সমন্বয় অসম্পূর্ণ, রিজার্ভ ও মুদ্রানীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব।

২. রাজনৈতিক অস্থিরতা: বছরের পর বছর পূর্ব নির্বাচনী দুর্ভাবনা কারণে ব্যবসা ও ভোক্তা মনোভাব দুর্বল।

৩. দুর্নীতি-বিনিয়োগ অসামঞ্জস্যতা: খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত।

৪. বিশ্বমুদ্রাস্ফীতি ও রপ্তানি নির্ভরতামূলকতা: বৈশ্বিক জ্বালানি ও খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি, রপ্তানিতে শুধু পোশাকশিল্প নির্ভরতা—নিয়োগের ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি।

৫. FDI অনিশ্চয়তা: প্রবাহ স্তিমিত, অর্থনৈতিক নীতি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিবেশ আকর্ষণীয় নয়।

৬. সুপারিশ: সমাধানের রূপরেখাঃ-

 (ক) স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা

বাজার নিয়ন্ত্রণে কড়া নজরদারি ও সিন্ডিকেট ভাঙুন।

হুন্ডি রোধে ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনতে উদ্যোগ।

অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ভর্তুকি না দিয়ে জরুরী দাম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করুন।

    * মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি জোরদার করা।

    * সিন্ডিকেট ভাঙতে শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

    * কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়া।

খ) দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর

  • রপ্তানিকে বহুমুখী করুন—IT, কৃষি, ওষুধ ও প্রযুক্তি খাতে গম্বরিত্ব বৃদ্ধি।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংক-অর্থমন্ত্রীর স্বচ্ছতা ও সংলাপ ভিত্তিক নীতি প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
  • ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
  • চিরকালীন মুদ্রানীতি নির্দিষ্ট, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও পেশাগত নীতি কার্যকর


        * শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ—যাতে জনশক্তি বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে।

        *রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কার ও খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

        * রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটি গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক রোডম্যাপ প্রণয়ন।

৭. উপসংহারঃ-

বাংলাদেশ বাজার অর্থনীতি বর্তমানে মায়া আর অস্থিরতার এক যুগ পার করছে।

যদিও দেশীয় উৎপাদন ও মানবসম্পদ এখনও শক্তিশালী, তবে সময়ের দাবি—দ্রুত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও দক্ষ অর্থনৈতিক সংস্কার।

এখনই সময়—রণনীতি সংশোধন, নেতৃত্ব পুনর্গঠন ও নীতি বাস্তবায়ন।

এতে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি পারবেন নতুন উচ্চতায় পৌঁছতে   

লেখক : কলামিষ্ট  ও রাজনীতিক বিশ্লেষক