বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে বন্দর চুক্তি: জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রয়োজন দূরদর্শী বাস্তবতা
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দর- যা দেশের আমদানি-রপ্তানির মূল প্রবেশদ্বার- অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের দখলে ছিল। ওয়েটিং টাইম, লজিস্টিক জট, প্রযুক্তির পশ্চাৎপদতা ও স্বচ্ছতার অভাব- সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় বন্দরটি ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে ৩৩৪তম অবস্থানে নেমে এসেছে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা এত নিম্ন মানে পড়ে থাকা- এটি অর্থনীতির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকেও দুর্বল করেছে।
এই দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতায় পরিবর্তন আনতে সরকার সম্প্রতি পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) ও চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের অপারেশন নিয়ে দুই আন্তর্জাতিক অপারেটরের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে। এই সিদ্ধান্ত যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে।
আরও পড়ুন: দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, ‘ত্যাগ, নির্যাতন ও আপোষহীনতার অনন্য প্রতীক’
কেন গ্লোবাল অপারেটর এখন সময়ের দাবি?
বিশ্বব্যাপী বন্দর ব্যবস্থাপনায় গত এক দশকে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। ভিয়েতনামের কাই মেপ বন্দর- যা আজ বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ৭ম- এই উন্নয়ন এসেছে গ্লোবাল অপারেটরদের পেশাদারি ব্যবস্থাপনার কারণে। আন্তর্জাতিক অপারেটররা কেবল উন্নত যন্ত্রপাতিই আনে না; নিয়ে আসে-
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণের বাইরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ‘অচল’ হওয়ার শঙ্কায় নগরবাসী
◑ডিজিটাল ট্রেসেবিলিটি
◑আধুনিক অপারেশনাল কালচার
◑প্রশিক্ষিত জনবল
◑শিপিং লাইনের সঙ্গে সরাসরি নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশের কাঠামোগত সমস্যা- দীর্ঘ ওয়েটিং টাইম, দুর্নীতি, অদক্ষ ম্যানপাওয়ার, দুর্বল প্রযুক্তি- এসব কাটিয়ে উঠতে আন্তর্জাতিক মানের অপারেশন ছাড়া কোনো পথই নেই।
বিদেশিদের কাছে বন্দর যাচ্ছে- এই অভিযোগ কতটা বাস্তব?
বৃহত্তর বিতর্কটি হলো-“বন্দর কি বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে?”
বিডা ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন পরিষ্কার করে জানিয়েছেন-
◑মালিকানা ১০০% বাংলাদেশের
◑APM Terminals এবং Medlog কেবল অপারেটর
◑নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে টার্মিনাল সম্পূর্ণরূপে সরকারের অধীনে ফিরে আসবে
◑নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন- সব সংস্থা আগের মতোই নিয়ন্ত্রণে থাকবে
এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত PPP Concession Model, যা চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ উন্নয়নশীল ও উন্নত সব দেশেই প্রয়োগ করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো- বিশ্ব যখন গ্লোবাল অপারেটর মডেলে এগোচ্ছে, তখন বাংলাদেশ কি পিছিয়ে থাকবে?
৩০ বছরের চুক্তি নিয়ে ভুল ধারণা:
অনেকে মনে করছেন ৩০ বছর অতিরিক্ত দীর্ঘ সময়। কিন্তু বৈশ্বিক তুলনা করলে দেখা যায়-
ভারত: ৫০-৬০ বছর, ভিয়েতনাম: ৫০ বছর, চীন: ৫০ বছরের করে থাকে।
বড় অবকাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি প্রয়োজন কেন?
◑বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার ◑জনবল প্রশিক্ষণ ◑প্রযুক্তি স্থানান্তর ◑স্থিতিশীল অপারেশনাল পরিবেশ।
অতএব বাংলাদেশের বাস্তবতায় ৩০ বছরের মডেলটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মধ্যেই পড়ে।
চুক্তি প্রকাশ না করা- কেন এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া:
প্রশ্ন উঠেছে- চুক্তি পুরোপুরি প্রকাশ করা হলো না কেন?
বিশ্বব্যাপী পিপিপি ও দরপত্র অর্থনীতিতে-
১) প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান সংবেদনশীল তথ্য পেলে ভবিষ্যৎ দরপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়
২) আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী গোপনীয়তা চায়
৩) বিশ্বব্যাংক ও ADB সারাংশ প্রকাশের পরামর্শ দেয়
অর্থাৎ জনস্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য- মালিকানা, আয় কাঠামো, মেয়াদ, বিনিয়ো- সব প্রকাশ করা হয়েছে। গোপন রাখা হয়েছে শুধুই বাণিজ্যিক সংবেদনশীল অংশ।
লালদিয়া ও পানগাঁও চুক্তিতে কী রয়েছে?
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (APM Terminals):
◑বিনিয়োগ: ৫৫ কোটি ডলার (৬৭০০ কোটি টাকা প্রায়)
◑সাইনিং মানি: ২৫০ কোটি টাকা
◑মেয়াদ: ৩৩ বছর (৩ বছর নির্মাণ + ৩০ বছর অপারেশন)
◑ সক্ষমতা: ৮-১০ লাখ TEUs
কনটেইনার হ্যান্ডলিং আয়:
◑৮ লাখ TEU পর্যন্ত: প্রতি TEU ২১ ডলার
◑তার বেশি হলে: প্রতি TEU ২৩ ডলার
পানগাঁও আইসিটি (Medlog SA):
◑বিনিয়োগ: ৪ কোটি ডলার
◑সাইনিং মানি: ১৮ কোটি টাকা
◑মেয়াদ: ২২ বছর
পানগাঁও টার্মিনাল ১০ বছর ধরে ব্যবহার হয়নি- এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে সক্ষম অপারেটর পাওয়া একটি ইতিবাচক সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
দীর্ঘ ৫৩ বছর উন্নয়ন আটকে ছিল কেন?
বন্দর আধুনিকায়ন বারবার আটকে গেছে একটি শক্তিশালী ত্রিভুজের কারণে-
১) দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির চক্র
২) সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ
৩) রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ব্যক্তিস্বার্থ
আধুনিক প্রযুক্তি বা স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা চালু হলে তাদের অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে যেত। এজন্য দীর্ঘ সময় ধরে একটি “উন্নয়ন-বিরোধী কাঠামো” তৈরি হয়েছিল।
এখন যখন এ কাঠামো ভাঙতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- কিছু গোষ্ঠী হরতাল, উস্কানি, নৈরাজ্যের ডাক দিচ্ছে স্পষ্টতই ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে।
কারা বিরোধিতা করছে?
◑বন্দরের বর্তমান ও সাবেক কিছু কর্মকর্তা
◑শ্রমিক নেতা
◑সিন্ডিকেটভুক্ত ব্যবসায়ী
◑কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং তাদের সুরে সুর মিলানো এক শ্রেণির অসাধু সাংবাদিক
যাদের ব্যক্তিগত আয়- উৎস, প্রভাবশালী অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর ভাষায়-
“যারা বন্দর থেকে চাঁদা তুলতেন, অনিয়মে সুবিধা নিতেন- তারাই এখন ‘দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।”
অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে লাভ কত বড় হবে?
১) ১.৮ লাখ TEU অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি যুক্ত হবে
২) বড় জাহাজ আসবে—ফলস্বরূপ পরিবহন খরচ কমবে
৩) বাংলাদেশের সঙ্গে ডাইরেক্ট শিপিং রুট বাড়বে
৪) হাজারো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে
৫) স্থানীয় কর্মীরা APM ও Medlog-এর আন্তর্জাতিক ট্রেনিং পাবে
৬) বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রিন পোর্ট স্ট্যান্ডার্ড চালু হবে
৭) কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ কমবে- রপ্তানিকারকের লাভ বাড়বে
সতর্কতা ও স্বচ্ছতাই সামনে এগোনোর পথ:
চুক্তি ভালো কিনা- তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো কিভাবে এটি বাস্তবায়িত হবে।
যা নিশ্চিত করতে হবে-
◑KPI ও পারফরম্যান্স নিয়মিত পর্যালোচনা
◑ডেটা নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি
◑প্রযুক্তি স্থানান্তরের অগ্রগতি
◑স্থানীয় জনবল দক্ষতা বৃদ্ধি
◑দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটমুক্ত পরিবেশ
চুক্তি গ্রহণযোগ্য- কিন্তু নজরদারি আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।
পরিশেষে বলবো, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এখানে যেকোনো উন্নয়নমূলক পদক্ষেপকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে অস্থিরতা তৈরি করা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়- এটি সরাসরি জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। অতএব- দুর্নীতি- সিন্ডিকেটের প্রভাব ভেঙে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের স্বচ্ছ ও আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। এই চুক্তি- সমালোচনা থাকুক বা না থাকুক- বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ রূপান্তরের দরজা খুলে দিয়েছে।
লেখক: এম এফ ইসলাম মিলন
ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট





