প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত

নিয়ন্ত্রণের বাইরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ‘অচল’ হওয়ার শঙ্কায় নগরবাসী

Sanchoy Biswas
সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ৬:৫৯ অপরাহ্ন, ২৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৯:৩১ পূর্বাহ্ন, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। নগরের পাড়া-মহল্লায় যেসব গলিপথ যানজটমুক্ত ছিল, সেগুলো আজ প্রধান সড়কের মতোই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির। নিয়ন্ত্রনের বাইরে থাকা ব্যাটারিচালিত অটোরিকসায় এবার অচল হওয়ার শঙ্কায় নগরবাসি। তবে চালকরা বলছেন, গরিরে যান-বাহন হিসেবেখ্যাত অটোরিকসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। এটাকে নিয়ন্ত্রনে আনলে তাদের পেটে লাথি মারা হবে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে ৫০০ শতাংশ। ঢাকায় বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমিত সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সংখ্যা বৃদ্ধির এই হার যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী তিন বছরে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিভিক ফাউন্ডেশন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন ৩৫টি থানায় ‘ঢাকা শহরের ব্যাটারিচালিত রিকশার বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা টুসিটার, ম্যানুয়াল ব্রেকনির্ভর ও ব্যাকগিয়ারবিহীন। পূর্ববর্তী বিভিন্ন সমীক্ষায় ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গের হিসেবে চিহ্নিত হলেও বর্তমান সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী ৬৫ শতাংশ চালক ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে আগত (তবে পা-চালিত রিকশা চালনায় উত্তরবঙ্গের চালকরা এখনও সংখ্যায় বেশি)। ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের ৩৫ শতাংশের বেশি এইচএসসি পাস এবং এক বছরের মধ্যে তারা ঢাকায় এসেছেন। তারা অনিবন্ধিত অটোরিকশা চালাতে গিয়ে নানাভাবে অনিয়ম এবং আইন ভঙ্গ করছেন। রাজধানী ঢাকায় এ দৃশ্য এখন পরিচিত বাস্তবতা। প্রায় প্রতিদিনই শত শত অবৈধ রিকশা জব্দ করে ট্রাফিক পুলিশ। এসবের সিংহভাগই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কিন্তু নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে এই বাহনের দৌরাত্ম্য কিছুতেই কমছে না। বরং রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার আধিপত্য স্পষ্ট। আইন অনুযায়ী, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমনসহ অপ্রচলিত যান চলাচল নিষিদ্ধ। উদ্দেশ্য— যানজট নিয়ন্ত্রণ, দুর্ঘটনা কমানো এবং সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশার বৈধতা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আইনি টানাপড়েন চলছে। আইন অমান্য করে এসব রিকশা চলাচল বাড়তে থাকলে ২০২৪ সালের ১৫ মে তৎকালীন সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণা দেয়। কিন্তু রিকশাচালকদের আন্দোলনের মুখে পাঁচ দিন পর সিদ্ধান্ত স্থগিত করে প্রধান সড়ক ছাড়া অন্যান্য সড়কে চলাচলের অনুমতি দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে মূল সড়কে নিয়ন্ত্রণ আর ধরে রাখা যায়নি। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজধানীর মূল সড়ক থেকে অলিগলি সবখানে তাদের দৌরাত্ম বেড়ে যায় বহুগুনে। একই বছর অটোরিকশা বন্ধে হাইকোর্টে রিট করা হলে আদালত তিন দিনের মধ্যে চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু আন্দোলনের মাঝে চেম্বার আদালত সেই আদেশও এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। ফলে ব্যাটারিচালিত রিকশা মূল সড়কেও চলতে থাকে এবং আগের চেয়েও বেশি।

আরও পড়ুন: দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, ‘ত্যাগ, নির্যাতন ও আপোষহীনতার অনন্য প্রতীক’

গত বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় মারা যান মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা করিম রাচি। চলতি নভেম্বরের শুরুতে নোয়াখালীতে ট্রাকের সঙ্গে একটি অটোরিকশার সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। একইভাবে গত ১২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে অটোরিকশার ধাক্কায় প্রাণ হারায় সাত বছরের শিশু আয়েশা। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চলাচলের কারণে এমন দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত এবং ৯৬৪ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ৭৭২টি যানবাহনের মধ্যে ১২.১৭ শতাংশই ছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক।

আরও পড়ুন: বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে বন্দর চুক্তি: জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রয়োজন দূরদর্শী বাস্তবতা

সরেজমিনে দেখা যায়, শাহবাগের ব্যস্ত সড়ক। এক কোণে নিঃশ্চুপ বসে আছেন ষাটোর্ধ সোহরাব মিয়া। চেহারায় ক্লান্তি, চোখে বিষণ্নতা, কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ! তিন দিন ধরে শাহবাগ থানায় ধরনা দিচ্ছেন একটি মাত্র আশায়-উপার্জনের অবলম্বন অটোরিকশাটা ফেরত পাবেন। কিন্তু জরিমানার টাকা জোগাতে না পেরে প্রতিদিনই ফিরছেন হতাশ হয়ে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সোহরাব মিয়া। তিনি বলেন, গরীব মানুষ আমি। খাইতে পাই না, জরিমানা ক্যামনে দেব? আগে প্যাডেল রিকশা চালাইতাম। ২-৩ বছর ধইরা ওই রিকশা চলে না। দেড় মাস হইছে ওইটা ভেঙে ব্যাটারির রিকশা নিছি। এখনও ধারের টাকা শোধ করতে পারি নাই। ঘরে চাল-ডাল নাই, রিকশাও নাই। এই বয়সে কী করমু? ভিক্ষা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই। সোহরাব মিয়ার মতো ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আর্তনাদ নতুন কিছু নয়। তারা অনিবন্ধিত অটোরিকশা চালাতে গিয়ে নানাভাবে অনিয়ম এবং আইন ভঙ্গ করছেন। রাজধানী ঢাকায় এ দৃশ্য এখন পরিচিত বাস্তবতা। প্রায় প্রতিদিনই শত শত অবৈধ রিকশা জব্দ করে ট্রাফিক পুলিশ। এসবের সিংহভাগই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কিন্তু নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে এই বাহনের দৌরাত্ম্য কিছুতেই কমছে না। বরং রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার আধিপত্য স্পষ্ট।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, শুধু ঢাকাতেই বর্তমানে ১২ থেকে ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। গত এক বছরে এই সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতি ১০টি রিকশার মধ্যে গড়ে ৭ থেকে ৮টিই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। তবে পরিস্থিতি এমন ছিল না এক-দুই বছর আগেও। দিনের বেলায় প্রধান সড়কে এই বাহনের চলাচল ছিল সীমিত। প্রথমদিকে কেবল অলিগলিতে দেখা গেলেও ২০২০-২১ সাল থেকে গভীর রাতে প্রধান সড়কেও অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। আর ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের  গণঅভ্যুত্থানের পর কিছুদিনের জন্য সড়কে ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে এই বাহনের অবাধ চলাচল বেড়ে যায়। যা এখন দেখা যাচ্ছে রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই। ২০১০ সালে চীন থেকে আমদানি করা ইজিবাইকের অনুকরণে দেশে প্রথম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে এর ব্যবহার বাড়লেও নিরাপত্তা ঝুঁকি ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঢাকার প্রধান সড়কে চলাচলে ছিল নিষেধাজ্ঞা। স্থানীয় মিস্ত্রিদের তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ এসব অটোরিকশার কোনো সরকারি অনুমোদনও নাই। আইন অনুযায়ী মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমনসহ অপ্রচলিত যান চলাচল নিষিদ্ধ। উদ্দেশ্য যানজট নিয়ন্ত্রণ, দুর্ঘটনা কমানো এবং সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশার বৈধতা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আইনি টানাপড়েন চলছে। আইন অমান্য করে এসব রিকশা চলাচল বাড়তে থাকলে ২০২৪ সালের ১৫ মে তৎকালীন সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণা দেয়। কিন্তু রিকশাচালকদের আন্দোলনের মুখে পাঁচ দিন পর সিদ্ধান্ত স্থগিত করে প্রধান সড়ক ছাড়া অন্যান্য সড়কে চলাচলের অনুমতি দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে মূল সড়কে নিয়ন্ত্রণ আর ধরে রাখা যায়নি। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজধানীর মূল সড়ক থেকে অলিগলি সবখানে তাদের দৌরাত্ম বেড়ে যায় বহুগুনে। একই বছর অটোরিকশা বন্ধে হাইকোর্টে রিট করা হলে আদালত তিন দিনের মধ্যে চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু আন্দোলনের মাঝে চেম্বার আদালত সেই আদেশও এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। ফলে ব্যাটারিচালিত রিকশা মূল সড়কেও চলতে থাকে এবং আগের চেয়েও বেশি। কথা হয়  ডেমরা-কদমতলী ও সবুজবাগ-খিলগাঁও ও কামরাঙ্গীরচরের কয়েকজন অটোরিকশা গ্যারেজ মালিকের সঙ্গে। তারা জানান, অটোরিকশা ব্যবসায় লাভ প্রায় দ্বিগুণ। চালাতে কষ্টও কম হয়। ফলে চালকরা এদিকে ঝুঁকছেন। অটোরিকশা চালকদের কয়েকজন জানান, শারীরিক পরিশ্রম কম হওয়ার পাশাপাশি প্যাডেল রিকশার চেয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়, ফলে আয়ও তুলনামূলক বেশি হয়। অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, এই পরিবহনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। কোনো সরকার এটি বন্ধ করতে চাইলে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন। অটোরিকশাকে অবিলম্বে বৈধতা দেয়ার দাবি জানান তিনি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যবসা যখন রমরমা তখন নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার ঐতিহ্য প্যাডেল রিকশা। খুব দ্রুত বিলীন হওয়ার পথে এগুলো। রাজধানীর প্যাডেল রিকশার গ্যারেজগুলোতে গেলেই এ চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। কামরাঙ্গীরচরের প্যাডেল রিকশা গ্যারেজ মালিক ফোরকান আলী জানান, একসময় তার গ্যারেজে ৬০টি প্যাডেল রিকশা ছিল। এখন আছে মাত্র ২০টি। এর মধ্যে ২–৩টি রিকশা ভাড়া দিতে পারেন, বাকিগুলো পড়ে থাকে। আগে দৈনিক ১২০ টাকায় ভাড়া পেলেও এখন ১০০ টাকায়ও চালক মিলছে না। আর্থিক সংকটে পড়লেও আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে অটোরিকশার ব্যবসায় যেতে চান না বলেও জানান ফোরকান।  যাত্রীরাও এখন প্যাডেল রিকশায় চড়তে চান না। এর প্রধান দু’টি কারণ: সময় বাঁচে এবং ভাড়াও তুলনামূলক কম। তবে সুবিধার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ঝুঁকির কথাও উঠে এসেছে যাত্রীদের মুখে। মিরপুরের অফিসকর্মী সজল আহমেদ জানান, শ্যামলী থেকে নিয়মিত অটোরিকশায় কর্মস্থলে যান। তার ভাষায়,  লোকাল বাসের ঝামেলা এড়াতে প্রায়ই অটোরিকশায় উঠি। অনেক সময় বাসের চেয়েও দ্রুত পৌঁছে যাই। ভাড়াও খুব বেশি না। তবে তিনি নিজেই অটোরিকশা-সংক্রান্ত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সময় বাঁচাতে বাধ্য হয়েই এই বাহন ব্যবহার করেন বলে জানান। আদাবরের নাজমা আক্তার বলেন, অটোরিকশায় সময় বাঁচে, ভাড়া কম— তাই ব্যবহার করি। তবে তিনি এটিও যোগ করেন, অনেক চালক নিয়ম মানে না, আর যত্রতত্র দাঁড়িয়ে রাস্তায় জ্যাম বাড়ায়। গত বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় মারা যান মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা করিম রাচি। চলতি নভেম্বরের শুরুতে নোয়াখালীতে ট্রাকের সঙ্গে একটি অটোরিকশার সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। একইভাবে গত ১২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে অটোরিকশার ধাক্কায় প্রাণ হারায় সাত বছরের শিশু আয়েশা। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চলাচলের কারণে এমন দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত এবং ৯৬৪ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ৭৭২টি যানবাহনের মধ্যে ১২.১৭ শতাংশই ছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অটোরিকশার প্রধান সমস্যা এর গতি নিয়ন্ত্রণ। অধিকাংশ রিকশারই কোনো ফিটনেস নেই; ফলে জরুরি অবস্থায় ব্রেক করা কঠিন হয়ে পড়ে। চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেকেই বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। অনিবন্ধিত হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে এসব অটোরিকশা। তাছাড়া যত্রতত্র পার্কিং এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতা রাজধানীতে যানজটও আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কথা হয় ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো: এনামুল হক এর সঙ্গে। তিনি বলেন, অধিকাংশ অটোরিকশাই ট্রাফিক আইন মানে না। এছাড়া অটোরিকশাগুলো রাস্তার যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার চেষ্টা করে, যা সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এর ফলে যানজট বাড়ে এবং মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। তিনি বলেন, নিবন্ধন না থাকায় এসব অটোরিকশার চালকদের পরিচয় শনাক্ত করাই প্রায় অসম্ভব। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিজ এলাকায় অপরাধ করে গা ঢাকা দিতে কেউ কেউ ঢাকায় এসে রিকশাচালকের পরিচয়ে জীবনযাপন শুরু করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক বিভাগের আরেক কর্মকর্তা বলেন,আমরা সবসময় অটোরিকশার বিরুদ্ধে। লাইসেন্স নেই, দক্ষতা নেই— দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো থাকবেই। তবে সরকার যদি নীতিমালা দেয়, তাহলে নির্দিষ্ট রুট ও নিয়ম-কানুনের মধ্যে রেখে এই রিকশাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়। ঝুঁকিপূর্ণ ও যানজট সৃষ্টিকারী যান হওয়ায় চলতি বছরের ২৫ আগস্ট অটোরিকশা বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তবে এই পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের বিষয়টিও মানবিকভাবে বিবেচনা করছেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন,অটোরিকশা বহু মানুষের জীবিকার উৎস, এবং তাদের জন্য এখনো বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেকটা অটো রিকশার পেছনে একটা পরিবার আছে। সেই পরিবারের জীবন-ধারণ কিন্তু এটাতে হয়। আমরা ওই পথেই যেতে চেষ্টা করছি যাতে সড়কে যানজট কমে। এজন্য আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু বাস্তবতা আছে যেগুলো আমাদের মেনে নিতে হবে।

এদিকে, উপদেষ্টা বন্ধ করার পক্ষে মন্তব্য করলেও চলতি জুলাইয়ে অটোরিকশার বৈধ নিবন্ধনের একটি খসড়া নীতিমালা করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। নীতিমালাটি এখন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন উক্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। তবে তিনি জানান, অটোরিকশার সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্থানীয় সরকার বিভাগের। নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো কিছুর এখতিয়ার তাদের নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ চেষ্টা করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে। কোন এলাকায় কত সংখ্যক অটোরিকশা নিবন্ধন পাবে বা চলাচল করবে, সেই সীমা নির্ধারণ করবে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী গঠন করা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি। মূল সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রেও থাকবে বিশেষ নীতিমালা। এ জাতীয় মোটরযানকে ফিটনেস সনদ নিতে হবে। অটোরিকশা চালকরা প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন।

রাজধানীজুড়ে অটোরিকশার লাগামহীন বিস্তারকে একেবারেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন না বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং খ্যাতনামা নগর পরিকল্পনাবিদ ড. এম শামসুল হক। মেট্রোরেল ও হাতিরঝিল প্রকল্পের এই পরামর্শক মনে করেন, এভাবে অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে চললে ঢাকার সড়কব্যবস্থা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বাড়বে, তেমনি ঢাকার যানজট মহামারির রূপ নেবে। তিনি বলেন, মারাত্মক বাজে প্রভাব পড়বে। ঢাকায় চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গাই নেই। যেখানে বাসের সবচেয়ে বেশি জায়গা পাওয়ার কথা, সেখানে বাসই জায়গা পাচ্ছে না। টেকসই সমাধানের জন্য বিশ্বজুড়েই বড় গাড়ি বাড়ানো হচ্ছে,আর আমরা উল্টো পথ চলছি। তিনি জানান, ছোট যানবাহনের আধিক্যে রাস্তার ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা কমবে, আর বিশৃঙ্খলা এত বাড়বে যে পুরো শহর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া রাস্তায় নানান অনিয়ম বাড়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি,রাস্তায় জায়গাই নেই। এসব ছোট গাড়ি রাস্তার যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক লাখ চালক তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে ফুটপাতে ছোট দোকান বসাচ্ছে। অন্যদিকে অনেকেই রিকশা রাস্তাতেই রেখে যায়। এতে অলিগলিতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।

আবেগ নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক। তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র ডাম্পিং বা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যার মূলে গিয়ে কাজ করলেই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসবে। হাজার হাজার গাড়ি ডাম্পিংয়ে নেওয়া হচ্ছে-এটাই সমাধান নয়। ওষুধ কাজ না করলে ডাক্তার ওষুধ বদলায়, তাই না? বারবার গাড়ি কেন ডাম্পিংয়ে নেয়া হবে? ব্যাটারিটা কে আনছে সেটা খুঁজে দেখা কি সম্ভব নয়? আসল সমস্যাটা তো তিনি তৈরি করছেন। এছাড়া বডিটা কে বানাচ্ছে, সেটাও তো খুঁজে বের করা সম্ভব। সমস্যার মূলে গিয়ে কাজ করতে হবে। তাৎক্ষণিক সমাধানে তো লাভ নেই। তিনি তথ্য দিয়ে জানান, ১৯৩টি দেশের কোথাও অটোরিকশা নেই। শুধু বাংলাদেশেই আছে। ভারতের কলকাতা প্রায় দুই দশক আগে মাত্র দুই বছরের পরিকল্পনা নিয়ে রিকশা তুলে দিয়েছে, সেটাও বাম সরকারের আমলে। আমরা কেন পারব না? সমাধান হিসেবে তিনি মোটাদাগে কিছু পরামর্শ দেন। সেগুলো হলো-অটোরিকশা শ্রমিকদের বিকল্প পেশায় যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া; একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করে রিকশা উঠিয়ে আনা; বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পুরোপুরি বাস্তবায়ন; সমস্যার মূলে গিয়ে আইন ও নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং হাতিরঝিলের মতো সুশৃঙ্খল চলাচল ব্যবস্থা অন্যান্য স্থানেও নিশ্চিত করা।