একজন কল্যাণকামী নেতার সন্ধানে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকালের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি দেশ, যার জন্ম হয়েছিল রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে, কিন্তু আজ সেই দেশ জর্জরিত দুর্নীতি, লোভ ও রাজনৈতিক ভণ্ডামিতে। এ দেশের মানুষ ক্লান্ত, হতাশ ও প্রতারিত। বহু বছর ধরে তারা দেখছে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ছলচাতুরি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং দেশকে নয়, নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ঘৃণ্য রাজনীতি। আজ বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনীতির ব্যবসায়ী নয় একজন কল্যাণমুখী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, নৈতিক নেতৃত্বসম্পন্ন প্রকৃত নেতা, যিনি মানুষকে ভালবাসবেন, সত্যকে অনুসরণ করবেন এবং দেশকে সেবার মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করবেন।
দশকের পর দশক ধরে আমাদের রাজনীতি দখল করে রেখেছে এমন এক শ্রেণি, যাদের রাজনীতি ক্ষমতার, প্রতারণার ও স্বার্থরক্ষার। তারা গণতন্ত্রের বুলি কপচায়, কিন্তু প্রতিদিন গণতন্ত্রকে অপমান করে। তারা ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের কথা বলে, কিন্তু তাদের কাছে এসব কেবল শ্লোগান জনগণকে প্রতারিত করার রাজনৈতিক অলঙ্কার মাত্র। গণতন্ত্র তাদের কাছে ক্ষমতার হাতিয়ার, জনগণের নয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে জলবায়ু, পরিবেশ এবং জলবায়ু অর্থায়নের অবস্থা: বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামীর পথ
এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকড় দুর্নীতির গভীরে প্রোথিত। এখন রাজনীতি আর জনসেবার ক্ষেত্র নয়, বরং লুণ্ঠন আর ব্যক্তিস্বার্থের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সরকারি অফিসগুলো হয়ে উঠেছে প্রভাব ও ঘুষের বাজার, আর ন্যায়বিচার একপ্রকার বিক্রিযোগ্য পণ্য। রাষ্ট্রের যে নৈতিক ভিত্তি একদিন স্বাধীনতার সংগ্রামে নির্মিত হয়েছিল, তা আজ ভেঙে পড়েছে। সততা এখন দুর্বলতা, আর দুর্নীতি একধরনের যোগ্যতা!
এই পরিস্থিতিতে একজন কল্যাণমুখী নেতার আহ্বান কেবল আবেগ নয়, এটি সময়ের দাবি। এমন নেতা যিনি স্বার্থ নয়, ত্যাগে বিশ্বাস করেন; ক্ষমতা নয়, দায়িত্বে আস্থা রাখেন; এবং জনগণকে শাসন নয়, সেবা করার পবিত্র কর্তব্য মনে করেন। প্রকৃত নেতা ভয় দেখিয়ে নয়, আদর্শ ও সততার মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন। তিনি বিভাজন নয়, ঐক্য সৃষ্টি করেন; ধ্বংস নয়, নির্মাণ করেন; লুণ্ঠন নয়, উন্নয়ন ঘটান।
আরও পড়ুন: রাজনীতি না চাঁদাবাজি? জনগণের ক্ষোভের ন্যায্য প্রশ্ন
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট রাজনৈতিক নয় নৈতিক। নেতৃত্বের এই নৈতিক শূন্যতা আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। জনসাধারণের অক্লান্ত পরিশ্রম, সহনশীলতা এবং আশা আজও এই দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাদের স্বপ্নগুলো প্রতিবারই ভেঙে দেয় সেই একই রাজনৈতিক চক্র, যারা দেশকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে। নির্বাচন আসে, প্রতিশ্রুতির বন্যা নামে, কিন্তু ফলাফল একই দুর্নীতির নতুন পোশাক, নিপীড়নের নতুন নাম।
গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হয়, যখন তার ভিত ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে জবাবদিহিতা এখন এক প্রকার কল্পকাহিনি। অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, আইন তাদের ধরতে পারে না। যারা রাষ্ট্রের ভেতরে অপরাধের আশ্রয়দাতা, তারাই আবার জনগণের রক্ষক সেজে বসে। এই দ্বিচারিতা আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যখন রাজনীতি অপরাধে পরিণত হয়, তখন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সমাজ হারায় তার নৈতিক দিকনির্দেশনা। তরুণ প্রজন্ম তখন বিশ্বাস হারায় তারা ভাবে, সততায় কিছু হয় না, দুর্নীতি ছাড়া সাফল্য নেই। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় আশার মৃত্যু। আর যখন আশাই মরে যায়, তখন একটি জাতি আত্মা হারায়।
একজন কল্যাণমুখী নেতা সেই আশাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তিনি ধনীদের পরামর্শ নয়, গরিবের আর্তনাদ শোনেন; সংবিধানকে সম্মান করেন, বিকৃত করেন না; প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেন, ধ্বংস নয়। তিনি জানেন, রাষ্ট্রের উন্নতি শুধু flyover বা সেতু নির্মাণে নয় বরং মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই দেশের মর্যাদা নিহিত।
স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো বারবার প্রতারিত হচ্ছি। দুর্নীতিবাজ, দালাল, সুবিধাবাদীরা মুখোশ পাল্টে নতুন রূপে ফিরে আসছে। যারা একদিন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম নিয়ে রাজনীতি করছে। নির্বাচন এলেই জাতিকে বাধ্য করা হয় দুই দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তির মধ্যে বেছে নিতে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রহসন!
এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেখানে সততা হবে শক্তি, সেবা হবে লক্ষ্য, আর ক্ষমতা হবে দায়িত্বের প্রতীক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ন্যায়, সমতা ও মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, কারণ আমরা এখনো প্রকৃত নেতৃত্ব খুঁজে পাইনি।
একজন কল্যাণমুখী নেতা বোঝেন ক্ষমতা কোনো বিশেষাধিকার নয়, এটি এক পবিত্র দায়িত্ব। তিনি জানেন, নেতৃত্ব মানে দেশকে ভালোবাসা, মানুষের কষ্ট বোঝা, এবং তাদের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া। তিনি প্রতিহিংসা নয়, পুনর্মিলন চান; বিভাজন নয়, ঐক্য চান। সর্বোপরি, তিনি নিজেকে নয়, দেশকে অগ্রাধিকার দেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এমন এক নেতৃত্বের ওপর, যে মানুষকে ব্যবহার নয়, অনুপ্রাণিত করবে; যে দেশকে শোষণ নয়, সেবা করবে। এমন নেতৃত্ব লোভ থেকে নয়, ত্যাগ থেকে জন্ম নেয়; প্রতারণা থেকে নয়, নৈতিকতা থেকে বিকশিত হয়।
আমরা অনেক সহ্য করেছি রাজনৈতিক প্রতারণা, দলীয় লুণ্ঠন, জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের দাবিতে উঠে দাঁড়ানোর। জনগণের হাতে এই রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা এমন একজন নেতার অপেক্ষায় আছি, যিনি আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেবেন যিনি দেশকে শুধু শাসন নয়, গঠন করবেন।
যতদিন না বাংলাদেশ সেই কল্যাণমুখী নেতাকে খুঁজে পায়, ততদিন আমরা গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে দুর্নীতির ছায়ায় বেঁচে থাকব। সময় এসেছে ইতিহাসের ডাকে সাড়া দেওয়ার নৈতিকতার, সততার ও মানবতার নেতৃত্ব দাবি করার।
তখনই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সেই স্বপ্নের দেশন্যায়, সমতা ও মানবমর্যাদার প্রকৃত রাষ্ট্র।
লেখক: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।





