পরিচালকদের অনিয়ম ও লুটপাটে বিশ্বস্ত সহযোগী ব্যাংকিং মাফিয়া
হাসিনার দোসর মাসরুরকে সিটি ব্যাংকে তৃতীয় দফায় এমডি নিয়োগে নানা প্রশ্ন

স্বৈরাচারের একনিষ্ঠ দোসর ব্যাংকিং মাফিয়া মাসরুর আরেফিনকে তৃতীয় দফায় সিটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ করায় আর্থিক সংশ্লিষ্টদের মাঝে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত ব্যাংকিং খাত। আর্থিকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকগুলো দখলের পাশাপাশি লুটপাটের জন্য বাছাই করা হয় কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে। সিটি ব্যাংক এমডি মাসরুর আরেফিন এই চক্রের নেতা। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আর্থিক খাতে সংস্কার শুরু হলেও পলাতক শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ এই সহযোগীকে তৃতীয় দফায় সিটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ করা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই নিয়োগের ফলে সিটি ব্যাংক স্বৈরাচারীদের দোসরদের নিরাপদ অভয়ারণ্যে পরিণত হলো।
স্বৈরাচারী শাসনামলে একনাগাড়ে দুই দফায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় পুরো ব্যাংককে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরেফিন। তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পরিচালকদের সকল অপকর্ম করার বৈধতা দিতেন এমডি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেকে লেখক, উপন্যাসিক পরিচয় দিলেও কার্যত শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার গুণগ্রাহী কিছু বই লিখে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের মাধ্যমে সরকারের কাছে নিজেকে অতি ভক্ত হিসেবে প্রকাশ করতেন।
আরও পড়ুন: ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার নাম পরিবর্তন
সিটি ব্যাংক সূত্র জানায়, মাসরুর আরেফিন ২০১৯ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদে এমডি ও সিইওর দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তৃতীয় মেয়াদে তিনি এ পদে নিয়োগ পেলেন। তৃতীয় দফায় তার নিয়োগের পর ব্যাংক থেকে জানানো হয়, গত ছয় বছরে মাসরুর আরেফিন সিটি ব্যাংককে ভিন্নতর উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ সময় ব্যাংকের বার্ষিক আয় ১ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় এবং পরিচালন মুনাফা ৬৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তার নেতৃত্বে সিটি ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার মুনাফার ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
গত ছয় বছরে ব্যাংকের আয়ব্যয়ের অনুপাত ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য বছরে ৩৬০ কোটি (৩.৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৭০২ কোটি (৭.০২ বিলিয়ন) ডলার হয়েছে বলে জানায় সিটি ব্যাংক। বলা হয়, গত ছয় বছরে ব্যাংকের মোট আমানত ২১ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকায় এবং ঋণ পোর্টফোলিও ২৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণের অনুপাত ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে, আর শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুপাত ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২২ শতাংশে উঠেছে।
আরও পড়ুন: বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান-এমডিসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি
তিনি ব্যাংকে ডিজিটাল ন্যানো লোন, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং ক্ষুদ্র ও মাইক্রোফাইন্যান্স বিভাগ চালু করেছেন। পাশাপাশি সিটিটাচ ডিজিটাল ব্যাংকিংকে আরও জনপ্রিয় করার কাজ করেছেন। ২০২৪ সালে সিটিটাচে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।
মাসরুর আরেফিন ১৯৯৫ সালে এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগ দিয়ে ব্যাংকিং পেশা শুরু করেন। ৩০ বছরের কর্মজীবনে তিনি এএনজেড ব্যাংক মেলবোর্ন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক কাতার, সিটি ব্যাংক এনএ, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যাংক থেকে বলা হয়, মাসরুর আরেফিন একজন ঔপন্যাসিক, কবি এবং অনুবাদক হিসেবেও পরিচিত।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, একমাত্র আওয়ামী কানেকশনের মাধ্যমে ছয় বছর আগে সিটি ব্যাংকে দায়িত্ব নেন বর্তমান এমডি।
সিটি ব্যাংক এমডি মুজিববাদী মাসরুর দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টমুক্ত করার চলমান পদক্ষেপে অনেক এমডি বাদ পড়লেও বহাল তবিয়তে আছেন। মুজিববাদী পরিচয়ে মাফিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গড়ে তুলেছেন একক আধিপত্য, যা ব্যাংকটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ১৯৯৫ সালে কয়েক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকে যোগদান করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে শীর্ষ পদ ভাগিয়ে নেন। তার কথিত উপন্যাস ও লেখা পড়লেই বোঝা যায় কতটুকু স্বৈরাচারীর সহযোগী ছিলেন।
উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ দিয়ে রাজনৈতিক উত্থান: সরকারের আস্থা অর্জনে ‘আগস্ট আবছায়া’ নামে লেখা উপন্যাসে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে রূপক আকারে তুলে ধরেন মাসরুর আরেফিন। তার লেখা তৎকালের জাতীয় শোক দিবসে একটি দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্রে শীর্ষস্থানে ছাপা হয়। নজর কাড়েন মাফিয়া ডন শেখ হাসিনাসহ দলটির নীতিনির্ধারকদের। ২০১৮ সালে ডিএমডি থাকাকালেই তিনি উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ লেখেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসটি মূলত ২০১৫ সাল থেকে তার মাথায় আসে।
এমডি হতে ওই উপন্যাসকে হাতিয়ার বানান তিনি। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বইটি লেখেন, যখন এমডি নিয়োগ নিয়ে সিটি ব্যাংকে আলোচনা চলে। হাসিনা-ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য প্রথমা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘আগস্ট আবছায়া’। শোক দিবসে পত্রিকায় মাসরুর আরেফিনের লেখা শীর্ষ সংবাদ, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর (কামাল চৌধুরী) ব্যবসায়িক পার্টনার সাহিদুল ইসলাম বিজুর সঙ্গে মাসরুর আরেফিন ঘনিষ্ঠতা রাখেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি সিটি ব্যাংকের এসডি হিসেবে নিয়োগ পান ‘আগস্ট আবছায়া’ লেখার সুবাদে। সেই পথচলা এখনো রয়েছে ব্যাংকটিতে। পরবর্তীতে দুর্নীতিবাজ কাজী নাবিলের জেমকন গ্রুপের সাহিত্য পুরস্কার (২০২০), সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক আইএফআইসি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯), ও ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বাগিয়ে নেন তিনি।
এ সাহিত্যকর্মের পরই ব্যাংকপাড়ায় তাকে ঘিরে তৈরি হয় এক ধরনের ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাবমূর্তি। তিন মেয়াদে সিটি ব্যাংকের এমডি পদে পুনর্নিয়োগ পাওয়া ও ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিবি) চেয়ারম্যান হওয়ায় সবকিছু মিলিয়ে তার একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে স্বৈরাচারের দোসরদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করে সিটি ব্যাংক।
সিটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে গত দেড় দশকে প্রায় একচেটিয়াভাবে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই জায়গা পেয়েছেন। ব্যাংকটির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান। গত ২৭ জুলাই আজিজ আল কায়সার টিটুকে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান, আনোয়ার গ্রুপের হোসেন খালেদকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই আগের কমিটি মাসরুরকে এমডি নিয়োগ দেয় আরও তিন বছরের জন্য।
সিটি ব্যাংক এখন আর কেবল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি পতিত আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক পরিপূরক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মাসরুর আরেফিন এ রাজনৈতিক-ব্যাংকিং মেলবন্ধনের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সব জায়গায় প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতে পলাতক খুনিদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগসহ দেশে নাশকতা তৈরি ও ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা তৈরিসহ নানা ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার উদ্বেগও দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় অঙ্কের ঋণসুবিধা প্রদান থেকে শুরু করে দলের ডোনার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছেন এ সিটি ব্যাংককে। ব্যাংকটি সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বড় ধরনের বরাদ্দ ছাড়াও কোটি কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের আমানত থেকে। এসব নিয়ে কোনো বাক্য প্রয়োগের মতো পরিবেশ রাখেনি ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ছিল নিষ্ক্রিয়।
দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে পুনরায় এমডি নিয়োগ বিতর্ক নিয়ে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান হোসেন খালেদকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা দিয়ে মন্তব্য নেওয়ার চেষ্টাতেও সাড়া দেননি হোসেন খালেদ।
দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে হালসময়ে উচ্চ মুনাফাতেও বঞ্চিত ব্যাংকটির শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা।
অন্যদিকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি বুঝে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সবশেষ ২০২৪ সালে সিটি ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে তার অংশ জোটেনি। মুনাফা বাড়লেও নগদ লভ্যাংশ কমে যাওয়ায় আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যার ফলে গত দুই বছর ধরে ব্যাংকটির শেয়ারদর খুব ঘন ঘন উঠানামা করছে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যের উপর ভরসা করতে পারছেন না অনেকেই। ভবিষ্যতে আর্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠবে তা আগাম পূর্বাভাস ধরে নিয়ে ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন শেয়ারবাজারের বড় অংশীদার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে গত দুই বছর ধরেই কমছে শেয়ার ধারণের অংশ।
ব্যাংক বড় অঙ্কের মুনাফায় থাকলে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার কেনার প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু সিটি ব্যাংকে তা ব্যতিক্রম হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের শেয়ারের অংশ কমছে দুই বছর ধরেই। পরিচালকরা কি আগাম তথ্য জেনে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, সেই প্রশ্নটি উঠছে। বড় অঙ্কের মুনাফা দেখানোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।