চার হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির আশঙ্কা

চট্টগ্রাম বন্দরে কাগজের আড়ালে আনা সিগারেট পেপার জব্দ

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৫০ অপরাহ্ন, ২১ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১২:০৬ পূর্বাহ্ন, ২২ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

পেপার রিবন ও স্ট্র পেপার আনার কথা বলে সিগারেট তৈরির কাঁচামাল ‘সিগারেট পেপার’ আমদানি করে আসছিল একটি চক্র। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব চালান আনা হচ্ছিল অচেনা বা স্বল্পপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জালিয়াতির এ তথ্য সামনে আসে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ‘আরএম এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘স্মার্ট মুভ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের চালান জব্দ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর পরীক্ষাগারে পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়, চালানগুলোতে আসলে সিগারেট পেপার ছিল।

আরও পড়ুন: আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল, বাধ্যতামূলক ছুটিতে বিএফআইইউ প্রধান

জুলাইয়ের মাঝামাঝি ঢাকাভিত্তিক আরএম এন্টারপ্রাইজ হংকং থেকে ১৬ টন ‘স্ট্র পেপার’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করে। এর কিছুদিন পর আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্মার্ট মুভও ‘পেপার রিবন’ আমদানির ঘোষণা দিয়ে প্রায় ১০ টন সিগারেট পেপার আনতে গিয়ে ধরা পড়ে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, আমদানি সংশ্লিষ্টরা এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষ পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে এসব চালান ঘোষিত নামেই ছাড় করানোর চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুন: হাসিনার দোসর মাসরুরকে সিটি ব্যাংকে তৃতীয় দফায় এমডি নিয়োগে নানা প্রশ্ন

কিন্তু পুনঃশ্রেণিবিন্যাস ছাড়া ছাড়পত্র পেলে, আরএম এন্টারপ্রাইজের এ চালানেই সরকার আমদানি শুল্ক বাবদ প্রায় ১ কোটি টাকা এবং সিগারেট উৎপাদনে ব্যবহৃত হলে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বাবদ প্রায় ৮৫ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে। একইভাবে স্মার্ট মুভের চালান ছাড়পত্র পেলে সরকারের শুল্ক বাবদ ক্ষতি হবে প্রায় ৭০ লাখ টাকা, মূসক বাবদ ৫০ কোটি টাকা।

কাস্টমস ও এনবিআর-এর নথি বলছে, এর আগে আরএম এন্টারপ্রাইজ প্রায় ২৭ কোটি টাকার বেশি আটটি চালান আনে। এর মধ্যে সিগারেট পেপারসহ ৪৮৯ টন সিগারেট তৈরির অন্যান্য কাঁচামাল ছিল। কর্মকর্তাদের সন্দেহ, ওই চালানগুলোতেও সিগারেট তৈরির কাঁচামাল ছিল, যার মধ্যে বেশিরভাগই আমদানি করা হয়েছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভ্যাট কর্মকর্তা জানান, এসব কাঁচামাল থেকে সরকারের প্রাপ্য ভ্যাট দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এসব টাকা আদায় প্রায় অনিশ্চিত, কারণ সরেজমিন যাচাইয়ে দেখা গেছে কোম্পানির ঠিকানাই অস্তিত্বহীন।

ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আরএম এন্টারপ্রাইজ এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, ওয়ারী শাখার মাধ্যমে প্রায় ৮২ কোটি টাকার লেনদেন করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আগের কোনো আমদানি বা ব্যাংক লেনদেনের রেকর্ড পাওয়া যায়নি। স্মার্ট মুভের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। দুটি প্রতিষ্ঠানই ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপান টোব্যাকোর এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিকেজি সিগারেট পেপার দিয়ে প্রায় ১০ হাজার সিগারেট তৈরি করা যায়, যেখানে ২ শতাংশেরও কম অপচয় হয়। এ কর্মকর্তা বলেন, “আমদানিকারকদের আমদানি শুল্কের পাশাপাশি প্রতিটি সিগারেটের খুচরা মূল্যে ৮৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। শুধু ২০ শলাকার একটি প্রিমিয়াম প্যাকের ভ্যাটই দাঁড়ায় অন্তত ৩০৭ টাকা।”

তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে সিগারেট তৈরি করা কোম্পানিগুলো সাধারণত ছোট ও অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নামে এসব কাঁচামাল আনে। কারণ মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে ছাড় করাতে পারলেই পরে বাজারে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।

আরএম এন্টারপ্রাইজের মালিক খোরশেদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তার আত্মীয় মোহাম্মদ জয়, যিনি নিজে এখন খোরশেদ আলমের ব্যবসার দেখভাল করেন, দাবি করেছেন, তারা স্ট্র পেপারই আমদানি করেছেন। তার ভাষায়, “এর আগের চালানগুলোতে আমরা স্ট্র পেপার আর অ্যাসিটেট তো এনেছি। অ্যাসিটেট তো সিগারেট ফিল্টারসহ ৪২ ধরনের জিনিস তৈরিতে ব্যবহার হয়। এসব পণ্য আমরা কোনো সিগারেট কোম্পানিকে বিক্রি করিনি।”

অন্যদিকে স্মার্ট মুভের মালিক কামরুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, চালানটি আসলে জনৈক রুবেলের, যিনি তার কোম্পানির নামে এলসি খুলেছিলেন। “চীনা সাপ্লায়ারের পরামর্শে আমি তাকে কোম্পানির নাম ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম। সব খরচ সে দিয়েছে। আমি তাকে একবারই দেখেছি, মিরপুরের অফিসে,” জানান কামরুল।

যদিও, দেশের ট্রেড লাইসেন্স ও ভ্যাট বিধি অনুযায়ী কোনো ট্রেড লাইসেন্স ভাড়া দেওয়া বা হস্তান্তর করা যায় না। ফলে ভ্যাট ফাঁকি প্রমাণিত হলে দায় কোম্পানির নিবন্ধিত মালিককেই নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার তফসির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, “যে পণ্যের নাম ঘোষণা করে আনা হয়েছে, সে নামে এ চালান ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। যদি আমদানিকারকরা পণ্য ছাড়াতে চান, তবে সিগারেট পেপারের শুল্ক পরিশোধ করতে হবে এবং মিথ্যা ঘোষণার জন্য জরিমানা দিতে হবে। প্রথমে তারা ছাড়পত্র চাইছিল, কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তারা যোগাযোগ করেনি। তারা আর যোগাযোগ না করলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”

তিনি আরও জানান, তারা সংশ্লিষ্ট ভ্যাট অফিসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাবে আগের আমদানি ও বিক্রির রেকর্ড যাচাই করে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে।