চবি শিক্ষার্থীদের সার্ভেতে, ‘সুন্দরবনের বাঘ সংকট কি বাস্তব নাকি পর্যবেক্ষণগত সীমাবদ্ধতা’

Sanchoy Biswas
মো. সাবিত বিন নাছিম, চবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৮:০৫ অপরাহ্ন, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:১৫ পূর্বাহ্ন, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় বিস্তৃত। বাংলাদেশে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কিছু অংশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলায় (উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা) অবস্থান করছে। মোট প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৬,৫১৭ বর্গকিলোমিটার (৬৬%) বাংলাদেশের অংশে এবং বাকি ৩৪% ভারতের অংশে অবস্থিত। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে সব সময় ঠেকিয়ে দেয় বুক চিতিয়ে। সুন্দরবন বাংলাদেশের ঢাল। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের অমূল্য সম্পদ। 

সম্প্রতি একাডেমিক কারিকুলামের অংশ হিসেবে  সুন্দরবনে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ২৭ তম ব্যাচের এক দল শিক্ষার্থী। সার্ভে করা শিক্ষার্থী দলের মধ্যে টিম ম্যাভরিকের অন্যতম বিষয় ছিল “সুন্দরবনের বাঘ সংকট কি বাস্তব নাকি পর্যবেক্ষণগত সীমাবদ্ধতা”। এই সার্ভে টিমের সদস্যরা হলেন দূর্জয়, নাহিদ, আবিদ, নওরাত।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫–২০২৬ শিক্ষাবর্ষের আইবিএ এমবিএ ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন

সার্ভের প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে টিম’টি জানায়, সুন্দরবনের নাম শুনলেই মনের মধ্যে যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জেগে ওঠে তা হলো স্বচক্ষে বাঘ দেখার আগ্রহ। ছোটবেলা থেকেই শুনেছি, সুন্দরবন মানেই বাঘ আর বাঘ মানেই সুন্দরবন। তাই ভ্রমণ শুরুর আগেই সবাই যেন সেই রহস্যময় সিংহল বাঘের ছায়ায় বিভোর। তারা আরও জানান, আমরা একে একে কচিখালি, দুবলারচর, কটকা অফিস, কটকা জামতলা, কোকিলমনি, হীরণ পয়েন্ট, করমজল, ডিমের চর এবং আন্দারমানিক ভ্রমণ করি। প্রত্যেকটি জায়গার বনময় পরিবেশ, নীরবতা এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। কিন্তু যেটি সবচেয়ে বেশি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তা হলো বাঘের অনুপস্থিতি। হঠাৎ করেই বাঘ দেখার সেই আগ্রহ যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পুরো ভ্রমণে বাঘ সরাসরি না দেখলেও ডিমের চরে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি। এক মূহুর্তের জন্য অনুভব করি সুন্দরবনের রাজা এখনও রাজত্ব করছে কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয়, অযত্ন এবং অব্যবস্থাপনার কারণে সে ধীরে ধীরে সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে।

“সুন্দরবনের বাঘ সংকট কি বাস্তব নাকি পর্যবেক্ষণগত সীমাবদ্ধতা” শীর্ষক সার্ভের সদস্যদের তথ্য মতে, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অনুসারে সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ৩ হাজার ৯০০, যা সত্যি উদ্বেগের বিষয়। সুন্দরবনে ২০১৮ সালে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালের জরিপে পাওয়া গেছে ১২৫টি। কিন্তু পূর্বে  ২০০৪ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ২০১৫ সালের জরিপ ছিল সর্বাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। ওই জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬টি। বাঘ অন্য প্রাণীদের স্বীকার করে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু যেভাবে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাতে আগামী দিনে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

আরও পড়ুন: জ্যোতির্বিদদের অনুসন্ধানে উন্মোচিত মহাবিশ্বের রহস্য

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলোও চিহ্নিত করছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের সার্ভেয়ার দলটি, তাদের তথ্য অনুসারে উক্ত কারণসমূহ হলো- চোরা শিকার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন - ঘূর্ণিঝড়, বন্যা), এবং খাদ্য সংকট। এছাড়া, মানুষের দ্বারা বন ধ্বংস ও আবাসস্থল হারানো এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধিও একটি বড় কারণ। 

শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণ তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ছে। এতে বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ায় কমে যাচ্ছে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। পাশাপাশি লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি না পেয়ে লবণাক্ত পানি পান করে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বাঘ। মিঠা পানীয় জলের অভাবে বাঘ অন্যত্র চলে যেতেও বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া নির্বিচারে বন উজাড়, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের বংশবৃদ্ধির ওপর।

এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সার্ভে টিমের অন্যতম পর্যবেক্ষক মোঃ নাঈম হোসেন দুর্জয় বলেন, সুন্দরবনের বাঘ শুধুমাত্র একটি দর্শনীয় প্রাণী নয়। এটি একটি সংকেত, যা আমাদের বলে দিচ্ছে যে বন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা না করলে তার দেখা কখনোই সহজ হবে না। আমরা হয়তো স্বচক্ষে বাঘ দেখিনি, কিন্তু তার পদচিহ্ন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে সুন্দরবন এখনো বাঘের জন্য একটি বাড়ি। আর সেই বাড়ি রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের হাতে।