নভেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদ পুর্নগঠনের আভাস
- বিতর্কিত খোদাবক্স স্বস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, আরও অনেকে সেইফ এক্সিট খুঁজছেন
- রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তিতে বাদ পড়তে পারেন আট উপদেষ্টা
- লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে প্রশাসন ও পুলিশের বদলি পদোন্নতি তদারকি করছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নভেম্বরের মধ্যেই উপদেষ্টা পরিষদ সংক্ষিপ্ত করে পূনর্গঠনের আভাস পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুতর আপত্তি দেওয়া উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারিরা এরই মধ্যে সম্মানের সাথে চলে যেতে ‘সেফ এক্সিট’র বিষয়টি আলোচনা চলছে। নির্বাচনকালীন লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করা সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের। রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতার জন্য রাজনৈতিক দল গুলোকে একনিষ্ঠভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আলোচনায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের সূত্র জানায় অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রশাসনের লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দল অনুগত কয়েকজন উপদেষ্টার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপি’র গুরুতর অভিযোগ দল সংশ্লিষ্ট তিন উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর বিরুদ্ধে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ সরকারি খোদাবক্স চৌধুরী শুক্রবার ভোরে স্ত্রী ফয়জুন্নেসা বেগমকে নিয়ে ১৫ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের স্বাক্ষরিত চিঠিতে আগামী ১১ নভেম্বর টার্কিস এয়ারলাইন্সে ৫:৩৫ মিনিটে দেশে ফিরবেন বলে উল্লেখ করা থাকলেও তা নিয়ে সংশয় আছে সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন: ৮ম ড্যাফোডিল ক্যাপ্টেন’স কাপ গলফ টুর্নামেন্ট-২০২৫ এর সমাপ্তি
পুলিশ প্রশাসনের বদলি পদোন্নতি র পুরো দায়িত্বই পালন করতেন এই বিশেষ সহকারি। রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতি ও নানা অভিযোগ প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়ে অপসারণের দাবির প্রেক্ষিতে তার দেশে ফেরা অনেকটাই সন্দেহজনক বলে মনে করা হচ্ছে। বিতর্কিতরা এভাবে সম্মানের সাথে এক্সিটের সুযোগ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সসম্মানে পদত্যাগের কথাও ভাবছেন- সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আলোচিত জ্বালানি উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান উপদেষ্টাদের আপত্তি নিয়ে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন।
গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী সরকার পতনের পর প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর পর বেশ কয়েকবার সংযোজন-বিয়োজনে পরিবর্তন আনা হয় সরকারে। কয়েক দফা নিয়োগের পর বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন।
আরও পড়ুন: নভেম্বরের মধ্যেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকের পর সচিবালয়ের উপদেষ্টা দপ্তর গুলোর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। উপদেষ্টাদের অনেকেই তাদের মেয়াদ শেষের কথা ভাবছেন। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত কাজ ছাড়া স্বাভাবিক কাজকর্মে অনেকের অনীহা। কেউ কেউ ঠিকমতো অফিসে আসছেন না। শুধু এই দুই উপদেষ্টার ক্ষেত্রে নয়, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তরে অনিষ্পন্ন সংস্কার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ‘তাড়া’ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদ নতুন করে গঠন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সূত্রটি জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার থাকা দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আরো সময় নিতে চেয়েছেন। এই দুই উপদেষ্টা হলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শুধু তাই নয়, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি সরকারে থাকতে চান। তবে আসিফ মাহমুদ গত ১৪ আগস্ট সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তিনি পদত্যাগ করবেন। অন্যদিকে মাহফুজ আলম গত ২৮ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে। একাধিক উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) প্রায় অভিন্ন ভাষায় জানান, ভাই! উপদেষ্টা স্যাররা আর কদিনই বা আছেন? আমাদের এখন যাওয়ার সময় হয়েছে। যেকোনো সময় আমাদের চাকরি নট হয়ে যাবে। একদিন হয়তো ঘুম থেকে উঠে শুনব স্যার নেই!
নির্বাচনকালীন প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার নিয়ে রাজনৈতিক চাপ:
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল মঙ্গলবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের আদলে ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এর পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদে থাকা দুই ছাত্র উপদেস্টা ‘দলঘনিষ্ঠ জালানী উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বক্স চৌধুরির অপসারন দাবী করেছেন। দলটির পক্ষ থেকে প্রশাসন ও পুলিশের সম্প্রতি বদলীর বিষয়টি তুলে ধরে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসনের দাবী জানান। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ, সচিবালয় এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রদবদলসহ আরও কিছু বিষয়ে বিএনপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান।
পরদিন বুধবার বিকেলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নির্বাচনের আগে উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হলে সেটা যেন ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে করা হয়, সেটি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন এনসিপির নেতারা। এ ছাড়া কাউকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, ‘বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী’ যেসব উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তাঁদেরও যেন বাদ দেওয়া হয়, সেটিও বলেছে এনসিপি।
জনপ্রশাসনে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ বদলি-পদায়ন নিয়েও বৈঠকে কথা বলেছে এনসিপি। বৈঠকের পর দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি ও শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
নির্বাচনের আগে উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হলে সেটা যেন ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে করা হয়, সেটি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন এনসিপির নেতারা। এ ছাড়া কাউকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, ‘বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী’ যেসব উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তাঁদেরও যেন বাদ দেওয়া হয়, সেটিও বলেছে এনসিপি।
একই দিন সন্ধ্যায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মো: তাহেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল।
বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানায় জামায়াত। জামায়াতের অভিযোগ, ওই উপদেষ্টারা প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকজন উপদেষ্টার প্রতি জামায়াতের অসন্তুষ্টি আছে। এই উপদেষ্টারা বিএনপির স্বার্থ বেশি দেখেন বলে জামায়াত বিশ্বাস করে। এ ছাড়া পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা বিএনপির প্রতি অনুগত বলে মনে করে জামায়াত। এমন কর্মকর্তাদের তালিকাও করেছে দলটি।
বুধবার ওই বৈঠকের পর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় ও পুলিশ প্রশাসনে ৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তা একটি দলের আনুগত্য করছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে সরকারের ভেতরে কী আলোচনা বা সরকার কী ভাবছে; সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে বৈঠকে দলগুলোকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মাধ্যমে দলগুলো সরকারের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের ওপরও চাপ তৈরি করতে চাইছে। সামনে যেহেতু নির্বাচন, সবাই সরকারের কাছ থেকে সুবিধা বা পৃষ্ঠপোষকতা নিতে চাইছে।
বিতর্ক এড়াতে উপদেষ্টাদের জন্য ‘অধ্যাদেশ’ জারির আহ্বান ফাওজুলের। অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রশ্ন ওঠায়, এই বিতর্ক এড়াতে অধ্যাদেশ জারির আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
শুক্রবার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনটি ফটোকার্ড শেয়ার করে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন রাজনৈতিক দলের বৈঠকে উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং একটি দলের তালিকায় তার নামও রয়েছে।
ফাওজুল কবির জানিয়েছেন, “আমি পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তা করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত নই। সবসময় অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তিনি আরও বলেছেন, “তবুও প্রশ্ন যেহেতু উঠেছে, এর নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, বিশেষ সহকারীবৃন্দ এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত সকল কর্মকর্তাদের কেউই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কোনো লাভজনক পদে অংশ নিতে পারবেন না। এই মর্মে একটি অধ্যাদেশ জারি করলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।”
ফাওজুল কবির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন, “নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন, তাদের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।





