প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বেপারী ঢাকা ওয়াসার নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৫:৩১ অপরাহ্ন, ১৩ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৫:৩১ অপরাহ্ন, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বেপারীকে সরকার আগামী তিন বছরের জন্য ঢাকা ওয়াসার নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ-২ শাখার উপসচিব আসফিকুন নাহার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে গত ১১ নভেম্বর অপরাহ্ণে এ নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬-এর ২৮(২) ধারা মোতাবেক জনাব মো. আব্দুস সালাম বেপারীকে ১১ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ অথবা যোগদানের তারিখ থেকে ৩ বছর মেয়াদে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগের জন্য সরকার অনুমোদন জ্ঞাপন করেছে। জনস্বার্থে এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

আরও পড়ুন: দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ আগামী সপ্তাহে

নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম বেপারী পানি সরবরাহ ও সুয়ারেজ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, দেশ ও বিদেশের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন কর্মকর্তা। তবে বিগত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের সময় আলোচিত ও বিতর্কিত তাসকিন এ খানের রোষানলে পড়ে তিনি পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে ওএসডি ছিলেন।

২০০৭ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডিএমএ ভিত্তিক পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ কাজ শুরু হয়। রাস্তা না খনন করেই মাটির নিচে পানি সরবরাহ পাইপ নেটওয়ার্ক তৈরি, জিআইএস প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সরবরাহ নেটওয়ার্কে আধুনিক সব কন্ট্রোলিং ও ডাটা লগিং ডিভাইস স্থাপনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সিস্টেমের সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাঁর ব্যক্তিগত এই পদ্ধতির সফলতাই পরবর্তীতে তাসকিনের তৎকালীন সরকারের নজরে আসে।

আরও পড়ুন: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিশ্বনেতাদের উত্থান, পতন ও পরিণতি

ঢাকা ওয়াসা দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ আব্দুস সালাম ব্যাপারী (পরিচিতি নং-০৫১৯) ১/০২/১৯৬৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে জ্যেষ্ঠতম প্রকৌশলী। দেশে-বিদেশে পানি নিষ্কাশন ও সুয়ারেজ বিষয়ক সবচেয়ে বেশি ডিগ্রিধারী তিনি।

তিনি এস.এস.সি পরীক্ষায় (রাজশাহী বোর্ড, ১৯৮১ সাল) কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগ এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষায় (ঢাকা বোর্ড, ১৯৮৩ সাল) ঢাকা কলেজ হতে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগ অর্জন করেন।

১৯৮৯ সালে (৮৩–৮৪ সেশন) বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) হতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে ২০০৪ সালে “The University of Melbourne, Australia” হতে “Utilities Management”-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৯১ সালে ঢাকা ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন এবং ধারাবাহিকভাবে একই সংস্থায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০২১ সাল হতে তৎকালীন বিতর্কিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম খানের দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় প্রতিহিংসাবশত পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়ে ওএসডি হিসেবে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে সংযুক্ত রাখা হয়।

বিগত সরকারের সরাসরি মদদপুষ্ট ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব তাকসীম এ খান-এর সকল অন্যায়, অনিয়ম, অপকর্ম ও দুর্নীতির দোসর না হওয়ায় এবং প্রতিবাদ করায় ২০১৭ সাল থেকেই তিনি তার রোষানলের শিকার হন।

ঢাকা ওয়াসার দীর্ঘ কর্মজীবনে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের রেকর্ড নেই। তার কাজের দক্ষতা, কৃতিত্ব ও সফলতার দৃশ্যমান বহু স্বাক্ষর রয়েছে, যার সাক্ষী হিসেবে ওয়াসার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমান।

(ক) প্রেসারাইজড সিস্টেমে ২৪/৭ ঘণ্টা বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের সবচেয়ে টেকসই পদ্ধতি “District Metering Area” (DMA) ধারণাটি ঢাকা ওয়াসায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৭ সালে, তার তত্ত্বাবধানে। উল্লেখ্য, DMA ভিত্তিক পানি সরবরাহ পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ বাংলাদেশে এই প্রথম।

রাস্তাখনন না করে মাটির নিচে পানি সরবরাহ পাইপ নেটওয়ার্ক তৈরি, Underground Utilities-এ জিআইএস (GIS) প্রযুক্তির প্রয়োগ (যা বাংলাদেশে এই প্রথম) এবং সরবরাহ নেটওয়ার্কে আধুনিক কন্ট্রোলিং ও ডাটা লগিং ডিভাইস স্থাপন করে মাঠ পর্যায় ও উপমাটির সকল তথ্য দূর থেকে (remotely) সংগ্রহের মাধ্যমে পানি সরবরাহ সিস্টেমের আধুনিক ব্যবস্থাপনার অগ্রযাত্রা তার হাতেই শুরু হয়।

(খ) এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এডিবি অর্থায়নে DMA ভিত্তিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার প্রথম ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্প “Dhaka Water Supply Sector Development Project (DWSSDP)” ২০১৫ সালে সম্পন্ন হয়। ঢাকা শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

এটি ঢাকা ওয়াসার ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সফল প্রকল্প। প্রকল্পটির সফলতা নগরবাসীর শতভাগ সন্তুষ্টি অর্জন করে। পাশাপাশি, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে এর প্রশংসা হয় এবং তাদের জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে, প্রকল্পের আওতায় সিস্টেম লস প্রায় শূন্য ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হওয়ায় ঐ দেশগুলোও অনুপ্রাণিত হয় এবং নিজ নিজ দেশে এই মডেল অনুসরণ করে।

বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পের সফলতা স্বীকৃতি দিয়ে প্রশংসাপত্র প্রদান করে। প্রকল্পের মূল অংশগ্রহণকারী হিসেবে এই সফলতার অন্যতম দাবিদার তিনি।

তবে, প্রকল্পের সফলতাকে পুঁজি করে বিতর্কিত তাকসীম এ খান “ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা” নামে ২০১২ সালে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। প্রকল্পের সফলতার পেছনের প্রকৃত অবদানকারীদের দূরে সরিয়ে দিয়ে কৃতিত্ব নিজের নামে প্রচার করেন এবং সরকার থেকে নানা অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেতন (৬.২৫ লাখ টাকা) গ্রহণকারী ব্যক্তি তিনি।

অপরদিকে, DWSSDP প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ই “Dhaka WASA Water Supply Master Plan” প্রণয়ন কাজ শুরু হয়। সে সময়েই তার তত্ত্বাবধানে আরও দুটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়—

(১) খিলক্ষেত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রজেক্ট, যা বর্তমানে “Dhaka Environmentally Sustainable Water Supply Project” নামে পরিচিত। এতে মেঘনা নদীকে পানি উৎস হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

(২) Dhaka Water Supply Network Improvement Project, যার মাধ্যমে DMA ভিত্তিক পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক ঢাকার অবশিষ্ট এলাকায় সম্প্রসারণ করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

উপরোক্ত প্রকল্প দুটি সরকারের ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অনুমোদন পায় যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। কিন্তু ২০১৭ সালে তাকসীম খান তাকে প্রকল্পগুলো থেকে সরিয়ে দেন। এতে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের অনেকেই বিদেশে চলে যান বা অবসরে যান।

প্রকল্প দুটি ২০১৬ ও ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তাকসীম খানের অনভিজ্ঞতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে আজও সেগুলো সম্পন্ন হয়নি। বারবার মেয়াদ বাড়ানোয় প্রকল্পগুলো অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিতে পড়েছে।

ফলে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতিতে DMA নেটওয়ার্কের অধিকাংশ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আবারও ৯০–এর দশকের সনাতনী পদ্ধতিতে ফিরে যাচ্ছে, এবং ২৪/৭ ঘণ্টা প্রেসারাইজড সিস্টেমে শতভাগ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পাওয়ার নগরবাসীর স্বপ্ন এখন অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে।