ঘন কুয়াশা-হাড়কাঁপানো শীতে জবুথবু দেশ

Sanchoy Biswas
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৫:৫৭ অপরাহ্ন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৫:৫৭ অপরাহ্ন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

পৌষের মাঝামাঝিতে এসে ঘন কুয়াশা আর হাড়কাঁপানো শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে রাজধানীসহ গোটা দেশ। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে ঘন কুয়াশা মিলে সারা দেশেই শীতের অনুভূতি প্রকট হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীসহ সারাদেশেই ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটছে, বাড়ছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। এদিন রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই কনকনে ঠান্ডায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষরা। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষ বেশি কষ্টে পড়ছেন। শীত নিবারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেক এলাকায় সকালে যান চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। এরই মধ্যে দেশের দিকে ধেয়ে আসছে নতুন শৈত্যপ্রবাহ ‘কনকন’। তবে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে দেশের অনেক জায়গায় এখনকার মতো শীতের অনুভূতি থাকতে পারে বলেও পূর্বাভাসে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গতকাল সোমবার ভোরের রাজধানী ঢাকা একেবারেই অচেনা শহরে পরিনত হয়েছে। এদিন কুয়াশার ঘন পর্দা ভেদ করে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে রাস্তাঘাট, ঠান্ডা বাতাসে কাঁপতে থাকে গাছের পাতা আর মানুষ। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমজীবীর জমে যাওয়া হাত, ফুটপাতে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা ছিন্নমূল মানুষের চোখে জমে থাকা ক্লান্তি, সব মিলিয়ে শীতের দাপটে জবুথবু এক নগরীর নীরব গল্প শোনা যায়। কনকনে ঠান্ডা আর কুয়াশায় ঢাকার ব্যস্ততা থমকে গেছে, শহর যেন শীতের সঙ্গে এক নিঃশব্দ লড়াইয়ে নেমেছে। রাতের ঠান্ডা বাতাস আর ভোরের ঘন কুয়াশা মিলিয়ে দিনের বড় একটা সময়ই কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে। রাজধানীতে গত কয়েক দিন ধরে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে চারপাশ। সকালবেলায় দৃষ্টিসীমা কমে যাওয়ায় সড়কে যান চলাচল ধীরগতির হয়ে পড়ছে। অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবীরা শীতের সঙ্গে কুয়াশাজনিত ভোগান্তিতে পড়ছেন। বিশেষ করে রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক ও পথচারীদের কষ্ট বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেকেই প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে কাঁপতে কাঁপতে কাজে বের হচ্ছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই পরিস্থিতি আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে, ফলে শীতজনিত ভোগান্তিও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রিকশাচালক আব্দুল করিম বলেন, এই শীত আমাদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের সময়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রিকশা নিয়ে বের হতে মন চায় না, কিন্তু না বের হলে সংসার চলে না। হাত-পা এত ঠান্ডা হয়ে যায় যে রিকশার হ্যান্ডেল ঠিকমতো ধরতেই কষ্ট হয়। যাত্রীও আগের চেয়ে কম। মানুষ ঠান্ডায় বের হতে চায় না, অনেক সময় ফাঁকা রিকশা নিয়ে বসে থাকতে হয়। তিনি বলেন, এদিন দুপুরের দিকে একটু রোদ উঠলে স্বস্তি পাই, কিন্তু বিকেল নামলেই আবার ঠান্ডা বাড়ে। গরম কাপড় বলতে একটা পুরোনো জ্যাকেট আর পাতলা কম্বল, এগুলো দিয়ে পুরো শীত পার করা কঠিন। রাতে বাসায় ফিরেও ঠিকমতো ঘুম হয় না। শীতে শরীর ব্যথা করে, জ্বর-কাশি লেগেই থাকে। সরকারের বা সমাজের কেউ যদি আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করত, তাহলে অনেক উপকার হতো। শীত শুধু ঠান্ডা না, আমাদের জন্য এটা টিকে থাকার লড়াই। মিরপুর এলাকায় ফুটপাতে বাসবাস করেন বৃদ্ধা রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, আমার বয়স হয়েছে, এই শীত শরীর আর সইতে পারে না। ফুটপাতে থাকি বলে ঠান্ডা সরাসরি গায়ে লাগে। রাতে ঘুমাতে গেলে মনে হয় হাড় ভেঙে যাবে। একটা পুরোনো শাল (চাদর) আছে, সেটাও পুরো শরীর ঢাকে না। অনেক সময় কুয়াশার মধ্যে সারারাত জেগে কাটে। আশপাশে গাড়ির শব্দ, ঠান্ডা বাতাস-সব মিলিয়ে খুব ভয় লাগে। তিনি আরও বলেন, অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই। শীতে জ্বর-কাশি বাড়ে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মানুষ মাঝে মাঝে খাবার দেয়, কিন্তু গরম কাপড় খুব কমই পাওয়া যায়। এই বয়সে সবচেয়ে বেশি দরকার একটু উষ্ণতা আর নিরাপত্তা। যদি রাতে থাকার মতো কোনো আশ্রয় থাকত, তাহলে এত কষ্ট হতো না। শীত আসলেই আমাদের কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে যায়। পোশাকশ্রমিক শিউলি আক্তার বলেন, শীত মানেই আমাদের কাজের চাপের সঙ্গে কষ্টও বাড়ে। সকালে খুব ভোরে বাসা থেকে বের হতে হয়। কুয়াশা আর ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা সবচেয়ে কঠিন। বাসে ভিড় বেশি থাকে, জানালা খোলা থাকলে ঠান্ডা আরও লাগে। কারখানার ভেতরেও অনেক সময় গরমের ব্যবস্থা ঠিক থাকে না। কাজ করতে করতে হাত শক্ত হয়ে যায়। তিনি বলেন, শীতের কাপড় থাকলেও সারাদিন কাজ করলে শরীর গরম থাকে না। শীতে অসুস্থ হলে ছুটি নেওয়া কঠিন, কারণ ছুটি মানেই মজুরি কাটা। অনেক সহকর্মী জ্বর-কাশি নিয়ে কাজ করছে। এই সময় যদি কারখানাগুলো গরম পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ আর শীতের উপযোগী ব্যবস্থা করত, তাহলে শ্রমিকদের কষ্ট কমত। শীত শুধু আবহাওয়ার বিষয় না, এটা আমাদের জীবনের বাস্তব লড়াই। রাজধানীর মগবাজার মোড়ে রিকশাচালক সালেহ আহমদ বলেন, শীতে হাত যেন বরফ হয়ে আসে। মৌজা পরে তো আর রিকশা চালাতে পারি না। প্যাডেলের রিকশা আমার, কষ্ট বেশি। আজকে মনে হয় আর সূর্য উঠবে না! ঠান্ডা বাতাসও কষ্ট দিচ্ছে। একই সুরে কথা বলেছেন রিকশাচালক মনির হোসেন। তিনি বলেন, শীতের কারণে মানুষ কম বাহিরে যাচ্ছে। সকালে রিকশা চালানো খুবই কষ্ট। গত কয়েক দিন থেকে সকাল সন্ধ্যায় রিকশা চালাতে পারি না। সকাল সন্ধায় আর বাহিরে থাকা কষ্ট। দুপুরের দিকে রোদ উঠলে কিছু স্বস্তি আসে। আজকে রোদও নেই। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী সাপ্তাহে শীত আরও বাড়তে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন: ২১ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ সর্বনিম্ন ৭.৫ ডিগ্রি

স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, শীতের এই তীব্রতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ফুটপাত, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও খোলা জায়গায় বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষদের জন্য শীত এখন বড় এক সংকট। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় শিশু ও বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় শীতজনিত রোগ-সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর শৈত্যপ্রবাহের সংজ্ঞা অনুযায়ী জানিয়েছে, বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। বর্তমানে দেশের কিছু অংশে মৃদু থেকে হালকা শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে রাতের তাপমাত্রা আরও ১ থেকে ২ ডিগ্রি কমলে পরিস্থিতি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে রূপ নিতে পারে। তবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কুয়াশার দাপট বেশি থাকছে। নদী অববাহিকা ও নিম্নাঞ্চলে কুয়াশার ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি, যার প্রভাব পড়ছে নৌযানে চলাচলে। আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানার সই করা বুলেটিনে বলা হয়েছে, সোমবার রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। মঙ্গলবার রাতে তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে, তবে দিনের তাপমাত্রা খুব একটা বদলাবে না। কাল বুধবার বছরের শেষ দিনে দিনের তাপমাত্রা কিছুটা কমে শীতের অনুভূতি আরও বাড়তে পারে। এছাড়াও ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত শীতের তীব্রতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানুয়ারিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, হাওর এলাকা ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি হতে পারে। এতে দরিদ্র ও খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী মানুষের জন্য ঝুঁকি আরও বাড়বে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শীতজনিত ঝুঁকি এড়াতে শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শীতে পর্যাপ্ত গরম কাপড় ব্যবহার, ভোরে অপ্রয়োজনে বাইরে না যাওয়া এবং গরম খাবার গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বা জ্বর দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে হাওর-অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জের নিকলীতে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া উত্তরের জেলা সিরাজগঞ্জের তাড়াশে তাপমাত্রা নেমেছে ১১ ডিগ্রিতে, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১১ দশমিক ৩, কুমিল্লা ও যশোরে ১১ দশমিক ৫, পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও নীলফামারীর ডিমলায় ১২, কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও নওগাঁর বদলগাছীতে ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা নগরবাসীর জন্যও তীব্র শীতের অনুভূতি তৈরি করেছে। ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অনেক এলাকায় সকালবেলায় সড়ক, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটছে। নৌপথে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল ধীর হয়ে পড়েছে, কোথাও কোথাও সাময়িকভাবে বন্ধও রাখা হচ্ছে। বিমানবন্দরগুলোতেও কুয়াশার কারণে ফ্লাইট শিডিউলে বিঘ্ন দেখা দিচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, দৃষ্টিসীমা কমে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে, তাই চালকদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: সারাদেশে ঘন কুয়াশা অব্যাহত, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির আভাস

এদিকে নতুন বছরের শুরুতে তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কুয়াশা পুরোপুরি কাটতে সময় লাগতে পারে। বিআইডব্লিউটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ কুয়াশার মধ্যে চলাচলের সময় হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলার নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে শীতবস্ত্র বিতরণ ও শীতকালীন প্রস্তুতি জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীতের ধরন বদলে যাচ্ছে। কখনো স্বল্প সময়ের মধ্যে তীব্র ঠান্ডা, আবার কখনো দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশাচ্ছন্ন ও শুষ্ক আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগাম প্রস্তুতি ও সচেতনতা জরুরি। শীতের এই হাড়কাঁপানো সময়ে জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।