রাজশাহী ওয়াসার ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে হরিলুটের আয়োজন

Abid Rayhan Jaki
বাংলাবাজার পত্রিকা রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৭:৩২ অপরাহ্ন, ০১ জুন ২০২৪ | আপডেট: ৫:২১ পূর্বাহ্ন, ০২ জুন ২০২৪
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

রাজশাহী ওয়াসা ৪ হাজার কোটি টাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন কাজ শুরু করলেও প্রকল্পের ভবিষ্যত নিশ্চয়তা, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ দেশি বিদেশি চক্র অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। একই ধরনের প্রকল্প ঢাকা ওয়াসা বাস্তবায়ন করলেও কাজের গুণগত মান টেকসই ও বরাদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পদ্মার ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে সরবরাহ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংসয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রকল্পে দেখা  যায়, পদ্মায় পানির উচ্চতা কমতে থাকলেও রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পদ্মার পানিকে প্রধান উৎস ধরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করছে ওয়াসা। ওয়াসা বলছে, সারা বছর এখানে অন্তত ৩০ ফুট গভীর পানি থাকবে। প্রতিদিন পানি সাপ্লাই দেবে ২০ কোটি লিটার। তবে ওয়াসার প্রকল্প নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, যেখানে পদ্মায় পানিই থাকে না, সেখানে এতো বড় প্রকল্প শেষমেষ আত্মঘাতী না হয়ে দাঁড়ায়। রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ও চীনের হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড যৌথভাবে কাজ করছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ১ হাজার ৭৪৮ কোটি ও হুনান কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে। প্রকল্পটি জুলাই ২০১৮ শুরু করে জুলাই ২০২৪ সালে শেষ করার কথা থাকলেও এখনও কাজ চলছে ধীর গতিতে। 

আরও পড়ুন: আশুলিয়ায় সেনা পুলিশের অভিযানে অস্ত্র-মাদকসহ গ্রেপ্তার ৪

অত্যন্ত ব্যয়বহুল রাজশাহী ওয়াসার এই প্রকল্প নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ ধরণের প্রকল্পে মূলে হল উন্নতমানের পাইপ ও অন্যান্য সামগ্রীর  ব্যবহার। কারণ এ ধরনের শোধনাগার কমপক্ষে ৭০ বছরের  জন্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজশাহী ওয়াসার ট্রিটমেন্টে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও অধিক প্রকল্প ব্যয় দেখানো হয়েছে। একই ধরণের ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পে দেখা যায় প্রায় একই টাকা ব্যয়ে তারা ৪৫ কোটি লিটার পানি শোধন করে সরবরাহ করেছে। আবার তারা ৩৪ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করেছে। ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পে একই বাজেটে ২ হাজার মিলিমিটার ডায়ার পাইপ স্থাপন করা হয়। ট্রিটমেন্টে উন্নত সামগ্রী ও ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত পানিশোধন প্রযুক্তি ও চীনের উন্নতমানের জিংজিয়ান কোম্পানীর পাইপ স্থাপন করা হয়। অপরদিকে রাজশাহী ওয়াসার প্রকল্পে দেখা যায় তারা একই বাজেটে ২২ কোটি লিটার পাানি শোধন করবে। ট্রান্সমিটার লাইন স্থাপন করবে ২৬ কিলোমিটার। ১ হাজার মিলিমিটার ডায়ার পাইপ লাইন স্থাপন করবে। নিম্নমানের গোয়ামিং কোম্পানি থেকে পাইপ সরবরাহ করবে। এতে করে দুই দেশের ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা বরাদ্ধকৃত অর্থেও মোটা অংকের লুটপাটের সুযোগ পাচ্ছে। রাজশাহী ওয়াসার প্রকল্প পরিচালক প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাসুদ জানান, ঋণ চুক্তি বিলম্ব করায় আমাদের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। প্রকল্পের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করে পানি উৎস নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়, একনেক ও ওয়াসা মিলে বাজেট ও প্রকল্প তৈরি করে অনুমোদন করেছে। আমি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে বাস্তবায়ন করছি। চায়নার ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। নির্মাণ সামগ্রী সিডিউল মতো বুঝে নিব। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজশাহীতে প্রতিদিন দুইশ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ সম্ভব হবে। পাশাপাশি ২০৩৫ সালের মধ্যে ওই অঞ্চলে পানি সরবরাহ শতভাগ কাভারেজের আওতায় আসবে।

রাজশাহীর কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা এক দশকে নেমেছে প্রায় ১০ মিলিমিটার। সেইসঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে নামছে রাজশাহী অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। শুষ্ক মৌসুমে মহানগরীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা থাকে ১৩ কোটি লিটার। চাহিদার বিপরীতে ওয়াসা সাপ্লাই দিচ্ছে ১০ কোটি ৭০ লাখ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ২ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি। ওয়াসা বলছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী পয়েন্টে চীন-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ৪ হাজার ৬২ কোটি ২২ লাখ টাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সংকট থাকবে না। 

আরও পড়ুন: শেষ কর্মদিবসেই বিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক

রাজশাহী ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা। চীনের হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড কাজটি বাস্তবায়ন করছে। পদ্মায় সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনে চীনা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২১ সালের ২১ মার্চ চুক্তি করে রাজশাহী ওয়াসা। এই ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমেই ২০৩৫ সালের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে পানি সরবরাহ শতভাগ নিশ্চিত করা হবে বলে আশা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের। প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। আড়াই থেকে তিন শতাংশ সুদে হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৩১৩ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা চার বছর।

ওয়াসা জানায়, শহরে এখন প্রতিদিন পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার পানি তোলা হয়। আর এখন মাত্র ৯০ লাখ লিটার ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করা হয়। তারপরও প্রতিদিন ১ কোটি ৭৭ লাখ লিটার পানির ঘাটতি থেকে যায়। নতুন প্লান্ট হলে ঘাটতি থাকবে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের খসড়া সম্পন্ন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন হয়। পরে একই বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রকল্পটি পাস হয়। এরপর নানা সমীক্ষা চলছিল। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরই চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। 

সরেজমিনে গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সারেংপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীর যে স্থানে ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি স্থাপন করা হচ্ছে সেখানেই ভারত থেকে গঙ্গা নদী বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা হয়েছে। এখান থেকেই আবার পদ্মার শাখা নদী হিসেবে বেরিয়ে গেছে মহানন্দা। দুই নদীর মোহনায় ওয়াসার এই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হচ্ছে। এরইমধ্যে জমি অধিগ্রহণ শেষ করে কাজ শুরু হয়েছে। চলছে বালু ভরাটের কাজ। পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বেজ ঢালাই ও পাইলিংয়ের জন্য মিক্সিং মেশিন। আগামী মাসে এই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে।

এদিকে, রাজশাহীর হরিপুর এলাকায় নির্মাণকাজ চলছে বুস্টার পাম্প প্রকল্পের। এই পাম্পের কাজও এগিয়ে চলেছে। এখানে মাটি খনন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বুস্টারপাম্প নির্মাণের জন্য বিদ্যুৎ সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ শেষের পথে। রাজশাহী ওয়াসা প্রকল্পের চীনা প্রধান প্রকৌশলী সানচিং বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। এরইমধ্যে ভরাটের কাজ শেষ করেছি। আগামীতে এখানে পাইলিং ও অন্যান্য কাজ শুরু করা হবে।

তবে এর আগেও ওয়াসার শত কোটি টাকার প্রকল্প খুব একটা কাজে না আসায় ওয়াসার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, অধিকাংশ সময় পদ্মায় পানি থাকে না। তার উপর এতো বড় প্রকল্প শেষে না আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ওয়াসা যে প্লান্টটি করছে, এটির যে ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে আমি মনে করি এটি ত্রুটিপূর্ণ। কারণ সেখানে পানি তুলছে জনস্বাস্থ্য, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন যোগ হয়েছে ওয়াসা। সেখানে পানি অ্যাভেলেবল কি না আমার জানা নেই। আপনারা জানেন ফারাক্কা পানি চুক্তি আগামী ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং আমার মনে হয় ওয়াসার এই প্লান্ট প্রকল্প আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কিছু না।

রাজশাহী সুজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন জায়গায় দাবদাহ চলছে। এর ভেতরে ওয়াসা পানির বিল বাড়িয়েছে। কিন্তু তাদের যে সেবা দেওয়ার কথা ছিল সেটা নাগরিক সমাজ পাচ্ছে না। নতুন করেও কোনো সুবিধা পায়নি।