কাশিয়ানীতে মৃত্যু ফাঁদে রূপ নিয়েছে উপজেলার সংকীর্ণ প্রবেশপথ
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার প্রবেশমুখ আজ এক অঘোষিত ‘মৃত্যু ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। ঢাকা–খুলনা মহাসড়ক থেকে উপজেলা সদরে ঢোকার একমাত্র প্রধান সড়কটি এতটাই সংকীর্ণ ও বেহাল যে প্রতিদিনই হাজারো মানুষ জীবনবাজি রেখে চলাচল করছেন। দীর্ঘদিনের অবহেলা, সড়ক উন্নয়ন না হওয়া এবং কোনো বিকল্প যোগপথ না থাকায় কাশিয়ানীতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ যোগাযোগ সংকট—যা যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মহাসড়ক থেকে উপজেলা সদরের দিকে মোড় নেওয়ার অংশটিতে চরম বিশৃঙ্খলা। বড় বাস, ট্রাক, লরি, পণ্যবোঝাই যানবাহন এবং ছোট পরিবহনগুলোকে সরু সড়কে ওঠা–নামার সময় প্রায় দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। মহাসড়কের প্রশস্ততা থেকে হঠাৎ সংকীর্ণ প্রবেশপথে ঢুকতে গিয়ে গাড়িগুলো গতি নিয়ন্ত্রণ হারানোর উপক্রম হয়, ফলে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একাধিকবার ধরতে হয় আপৎকালীন ব্রেক—যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: রূপগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও লুটপাট গুলিবিদ্ধ ১, আহত ৫
অপরদিকে বিকল্প হিসেবে যে ছোট বাইপাস সড়কটি রয়েছে, সেটি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পথজুড়ে খানা–খন্দ, ভাঙাচোরা অংশ, জমে থাকা পানি এবং কাদাযুক্ত জায়গায় ছোট যানবাহন চলাচলও বিপজ্জনক। স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটির অবস্থা দেখে মনে হয় বহু বছর ধরে কেউ এটি দেখভাল করেনি। ‘উপজেলায় ঢোকার পথটাই আজ সবচেয়ে লজ্জার।’
কাশিয়ানী জি.সি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়মা ইসলাম প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে স্কুলে আসে। ভয় আর অনিশ্চয়তার কথা জানিয়ে সে বলে, “প্রতিদিন স্কুলে আসতে ভয় লাগে। রাস্তা এত সরু আর ভাঙা যে মহাসড়ক পার হওয়ার সময় মনে হয়—হয়তো আজই দুর্ঘটনা ঘটবে। অনেক সময় ট্রাক আর বাস খুব কাছ দিয়ে যায়, তখন মনে হয় জীবনটা ঝুঁকিতে আছে। আমরা তো বাচ্চা, আমাদের নিরাপদ রাস্তা দরকার।”
আরও পড়ুন: নরসিংদীতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রবাসী নিহত, গুলিবিদ্ধসহ আহত ১০
ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন বলেন, “ছুটির সময় গাড়ির চাপ বেশি থাকে। রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও হঠাৎ বড় গাড়ি ঢুকে পড়ে। কয়েকবার খুব ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখেছি। কবে যে এই রাস্তা ঠিক হবে, জানি না।”
কাশিয়ানী সদর এলাকার বাসিন্দা মো. মাহাবুব আলম ফকির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই প্রবেশপথটা এখন রাস্তা নয়, একেবারে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সামনে বড় বাস, পেছনে ট্রাক—সংকীর্ণ ঢালে দাঁড়িয়েই যেন দুর্ঘটনা ডেকে আনে। আমরা তো কোনো উন্নত সড়ক চাই না—শুধু নিরাপদে চলাচলের পথটাই চাই। এই সংকীর্ণ প্রবেশপথ আর গর্তে ভরা রাস্তার কারণে প্রতিদিন মানুষ ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে। প্রশাসন যদি একবার এখানে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখত, তাহলে বুঝত—এই রাস্তাটা রেখে জীবন বাঁচানো যায় না। এভাবে আর কতদিন ঝুঁকি নিয়ে বাঁচব? রাস্তা প্রশস্ত না হলে বড় দুর্ঘটনা শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
মোটরসাইকেল চালক রিয়াদ শেখ বলেন, “এই প্রবেশপথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো মানে প্রতিদিন মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। সামনের দিকে ট্রাক, পেছনে বাস—সংকীর্ণ রাস্তার ঢালে উঠলেই মনে হয় বাইকটা কখন যে উল্টে যাবে। গর্ত, ধুলো আর ভাঙা প্রান্ত—সব মিলিয়ে এই জায়গাটাই মোটরসাইকেল চালকের জন্য দুঃস্বপ্ন। একটু গতি কম–বেশি হলেই নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। যেন জীবনের চেয়ে ভাগ্য ভালো থাকলেই কেবল এই রাস্তা দিয়ে নিরাপদে ফেরা যায়। প্রবেশপথটা ঠিক না করলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনায় রাস্তাই কাঁদবে, মানুষ নয়।”
বাসচালক তানভীর মাসুদ জানান, “মহাসড়ক থেকে উপজেলায় ঢোকার মোড়ে সবচেয়ে ভয় লাগে। বড় গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে সামান্য ভুল হলেই বড় দুর্ঘটনা হয়ে যায়। বাইপাস আছে ঠিকই, কিন্তু এত সংকীর্ণ ও ভাঙা যে কেউ ব্যবহারই করতে পারবে না। এই প্রবেশপথে স্টিয়ারিং ধরলেই মনে হয় যেন মৃত্যুর সঙ্গে দৌড় চলছে। মহাসড়ক থেকে নামামাত্রই রাস্তা এত সরু হয়ে যায়—একটা ভুল মানে সোজা ট্রাকের নিচে চলে যাওয়া। আমরা প্রতিদিন যাত্রী নিয়ে এখানে ঢুকি, কিন্তু মাথার ভেতর ভয় ঠিক একই জায়গায় থাকে। রাস্তাটার অবস্থাই এমন—যেন দুর্ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে। সংকীর্ণতা এমন যে রাতে লাইটের প্রতিফলনেই রাস্তার সীমানা হারিয়ে যায়। জীবন নিয়ে খেলেই এই পথে চালাতে হয়।”
ট্রাকচালক লিটন মোল্লা জানান, “এটা কোনো উপজেলার প্রবেশপথ? মনে হয় গুদামঘরের ভাঙা গলিপথ। বড় গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে প্রতিদিনই মনে হয় উল্টে যাব। গর্ত, কাদা আর সরু পথ—সব মিলিয়ে এটি দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবেশমুখগুলোর একটি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখ যেন কিছুই দেখছে না। যখনই মহাসড়ক থেকে বাঁক নেই, মনে হয় ‘এবারই বুঝি শেষ’—এমন ঝুঁকি নিয়ে চালানো বিশ্বের কোথাও দেখিনি।”
উপজেলা বাজার ব্যবসায়ী সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হিরো মৃধা বলেন, “রাস্তাটা বড় না হলে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য এগোবে না। বাইরে থেকে ট্রাক দিয়ে মাল আনতেও ভয় লাগে—যেকোনো সময় দুর্ঘটনা হবে, এই চিন্তা মাথায় রাখতে হয়।”
ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, গণপরিবহন চালকসহ স্থানীয়দের অভিযোগ—কাশিয়ানী উপজেলা গোপালগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ও জনবহুল এলাকা। প্রতিদিন হাজারো মানুষ উপজেলা সদরে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রবেশপথের এই সংকীর্ণতা শুধু মানুষের জীবনঝুঁকি নয়, বরং স্থানীয় বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কৃষিপণ্য পরিবহনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
স্থানীয়রা জানান, সড়কটির বেহাল অবস্থার বিষয়টি বহুবার স্থানীয় প্রশাসন, সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং জনপ্রতিনিধিদের জানানো হলেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্ষার সময়ে পানিতে ডুবে যায় রাস্তাটির কয়েকটি অংশ, শুষ্ক মৌসুমে ধুলোবালির কারণে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। “জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলার প্রবেশ সড়ক বছরের পর বছর এমন অবহেলায় পড়ে থাকবে কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পরই কি সবকিছু নড়াচড়া শুরু করবে?”
স্থানীয় জনসাধারণ প্রবেশপথটিকে নিরাপদ ও আধুনিক করার জন্য অবিলম্বে পাঁচটি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন—
১. প্রধান প্রবেশ সড়ক প্রশস্ত করা ও অবিলম্বে সংস্কার
২. বিকল্প বাইপাস সড়ক দ্রুত পুনর্নির্মাণ ও যান চলাচল উপযোগী করা
৩. মহাসড়কের সংযোগস্থলে সিগন্যাল, সাইনবোর্ড ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন
৪. যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ বা অটোমেটেড সেফটি ব্যবস্থা
৫. মহাসড়ক–উপজেলা সংযোগস্থল আধুনিক মানে উন্নীতকরণ
“যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে কাশিয়ানীর প্রবেশপথ পুরোপুরি মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্যস্ত মহাসড়কে সংকীর্ণ প্রবেশপথ, সিগন্যালবিহীন সংযোগস্থল ও খানা–খন্দে ভরা বাইপাস সড়ক—এ তিনটির সমন্বয় যেকোনো অঞ্চলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। কাশিয়ানীর এই প্রবেশমুখও একই শঙ্কা বহন করছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলে তারা মনে করেন।





