দুই বোন বাঁচিয়ে রেখেছেন যে ভাষা

Sanchoy Biswas
মৌলভীবাজার সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ৭:০১ অপরাহ্ন, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | আপডেট: ৩:০৭ অপরাহ্ন, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত

মৌলভীবাজার চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তা খাড়িয়া। তাদের মাতৃভাষার নাম খাড়িয়া। চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা ছিল। কিন্তু সময়ের গতিধারায় চা বাগান থেকে ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন মাত্র দুই নারী ৮০ বছর বয়সি ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সি খ্রিস্টিনা কেরকেটা। আদি খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। সম্পর্কে দুই বোন। এরা বহু আগেই জাতপাত, সংস্কৃতি, ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশের একটি ভাষার শেষ প্রতিনিধি। এই দুইজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষা সহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত ভাষা খাড়িয়া।  

শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নে সরেজমিনে রাজঘাট চা বাগানে ঘুরে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজন পাওয়া গেলেও ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও প্রকৃত খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজার পর বর্মাছড়া ভেরোনিকা কেরকেটার দেখা হলে এসময় তিনি খাড়িয়া ভাষা ও বাংলায় বলেন, আমাদের মা বাবা ভারতের রাচি থেকে চা বাগানে নিয়ে আসা হয়। এখানে আমাদের জন্ম হয়। আমরা ছোট বেলা থেকেই বাবা মা বলতো। তাদের কাছ থেকে শিখা। বর্তমানে বাগানে অনেক ভাষার মিশ্রণে আমাদের সন্তানরা আমাদের ভাষা বলতেও পারে না। এমনকি বুঝেও না। এই বাগানের মধ্যে আমরা দুই বোন খাড়িয়াতে কথা বলতে পারি। সুখ দু:খে আমরা আমাদের দুই বোনের মধ্যেই আমাদের ভাষায় কথা বলি। এতে আমাদের প্রাণ খুলে মনের ভাব প্রকাশ করি। পরিবারের অন্যরা সহ বাগানে কারো সাথে আমরা দুই বোন প্রাণ খুলে মনের মতো করে কথা বলতে পারি না। এটাই আমাদের দু:খ। 

খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, আমরা দুই বোন একই বাগানের পাশাপাশি সেকশনের কলোনিতে সপরিবারে বসবাস করি। তাই যখন সময় পাই আমরা দুই বোন একত্রে বসে আমাদের ভাষায় কথা বলি। এছাড়া আর কারো সাথে খাড়িয়া ভাষায় খুব একটা আলাপচারিতা হয় না। এ কারণে খাড়িয়া ভাষাটি অনেকটা মৃত্যুর মুখে। মাংরা বস্তীর খাড়িয়া সম্প্রদায়ে জহরলাল ইন্দোয়ার সামান্য খাড়িয়া ভাষা বলতে পারেন। 

তার সঙ্গে কথা হলে, তিনি বলেন খাড়িয়া ভাষা ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ভারতের রাচিতে খাড়িয়া ভাষার বহুল প্রচলিত। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা রাচি থেকে এদেশে চা বাগানে নিয়ে আসা হলে সে সময়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চা বাগানগুলোর মধ্যে বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চা বাগানের অনেকগুলো ভাষা সংরক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে আজ বিপন্ন। খাড়িয়া ভাষায় কথা বলেন মাত্র দুজন নারী। আমি সামান্য বলতে পারি। বাকি খাড়িয়া জনগোষ্ঠী সাদ্রিবাংলা, দেশোয়ালি ও খাড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলে। আমাদের ভাষা সংরক্ষণে জন্য কোন রকমের উদ্যোগ কিংবা বই পুস্তক নেই। ভারত বর্ষে এর যথাযথ উপকরণ থাকলেও বাংলাদেশে খাড়িয়া ভাষার কোনো বর্ণমালা না থাকায় আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত। বাংলায় লেখা পড়ার কারণে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। 

খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে আলাপকালে বর্মা ছড়ার খাড়িয়া সম্প্রদায়ের সন্তান, শ্রীমঙ্গল দ্বারিকা পাল কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, লিজা ইন্দোয়ার, শ্রীমঙ্গল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমা ইন্দোয়ার বলেন, আমাদের মাতৃভাষা যে খাড়িয়া তা বাপ দাদার কাছে শুনেছি, কিন্তু শিখতে পারি নাই। বাংলায় লেখাপড়া করি আর বাবা-কাকারাও বাংলা, দেশোয়ালি ও ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলে। যার কারণে আমরা আমাদের মাতৃভাষা এখন বলতে পারি না। এমনকি বুঝিও না। তবে মাতৃভাষা সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক বলে দাবি তাদের। ভেরোনিকা কেরকেটার বাড়িতে কথা হয় মৌলভীবাজার জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ম. আব্দুল মতিনের সঙ্গে। 

এসময় তিনি খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা প্রাণোজ্জ্বল একটি ভাষা উল্লেখ করে বলেন,৮০ বছর বয়সি ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সি খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুজনের মৃত্যু হয়ে গেলে হারিয়ে যাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা খাড়িয়া। এতে আমাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক সম্পদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। 

রাজঘাট ইউপি, প্যানেল চেয়ারম্যান, মো. সেলিম আহমদ বলেন, রাজঘাট চা বাগানে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। ২০১৭ সালে আমাদের বর্মাছড়া বাগানের উত্তরণ যুব সংঘের মাধ্যমে বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার নামের একটি খাড়িয়া ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মাধ্যমে কিছু শিশুকে খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হলে সেটা তেমন সফলতার মুখ দেখে নাই নানা সংকটের কারণে। বর্মাছড়ার দুই নারীর মৃত্যুর পর দেশ থেকে খাড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাবে উল্লেখ করে রাজঘাট ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জি বলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিজস্ব ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। এর মধ্যে একটি খাড়িয়া ভাষা। তাই এটি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের দাবি জানান।

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, বাংলা বিভাগ, সহযোগী অধ্যাপক, মোহাম্মদ আব্দুল হালিম জানান, যেহেতু দুই নারী ছাড়া দেশে আর কেউ ভাষাটি জানে না, বোঝে না বা চর্চা করে না; তাই সহজেই অনুমেয় যে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাষা খাড়িয়া। । সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মাতৃভাষার নিজস্ব বর্ণমালা থাকার পরও শুধু মাত্র পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাড়িয়া ভাষা হারানোর পথে আরও একটি ভাষা।