ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাজুবাদাম

কিডনি আকৃতির বীজ কাজুবাদাম গন্ধ ও স্বাদে মিষ্টি-জাতীয়। ওজন হ্রাস, রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর হৃদয় গঠন, ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধ, ত্বক ও চুলের সুরক্ষায় এটি এক দারুণ পুষ্টিকর খাবার। যার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যানাকার্ডিয়াম অক্সিডেন্টাল। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বেলে দো আঁশ মাটি অথবা পাহাড়ের ঢালে ভাল জন্মে। কাজুবাদামের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিলসহ মধ্য আমেরিকা এবং উত্তর দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর পূর্ব ব্রাজিল। বর্তমানে প্রধানত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়ে থাকে।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হর্টিকালচার সেন্টার খেজুরবাগান, সেনানিবাস, হর্টিকালচার সেন্টার নারানখাইয়া, পানখাইয়া পাড়া, কমলছড়ি ও জামতলী এলাকায় কাজুবাদামের গাছ চোখে পড়ে। এ ছাড়া, রামগড় উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টারেও রয়েছে কাজুবাদামের বাগান। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝারি আকারে কাজুবাদামের চাষ হচ্ছে। অনাবাদি জমিতে পরিকল্পিতভাবে কাজুবাদাম চাষের যথেষ্ট সুযোগ আছে।
আরও পড়ুন: জীবনরক্ষাকারী ৭৩৯ ওষুধের দাম নির্ধারণ করবে সরকার
পুষ্টি উপাদান যেমন তামা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, ফসফরাস, আয়রন, সেলেনিয়াম, থায়ামিন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিপদার্থ ভিটামিন কে, ভিটামিন বি৬ ইত্যাদিতে ঠাসা কাজু বাদাম। এর ১ আউন্স বা প্রায় ২৮.৩ গ্রাম কাজু বাদাম থেকে মোটামুটিভাবে ১৫৭ গ্রাম ক্যালরি, ৫.১৭ গ্রাম প্রোটিন, ১২.৪৩ গ্রাম ফ্যাট, ৮.৫৬ গ্রাম শর্করা, ০.৯ গ্রাম ফাইবার, ১.৬৮ গ্রাম চিনি পাওয়া যায়।
মানবদেহের রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজু বাদাম কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস এক ঘাতক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগ প্রতিরোধে কাজু বাদাম সহায়ক হতে পারে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা।
আরও পড়ুন: বাড়ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ: ঝুঁকিতে লক্ষাধিক মানুষ
কাজু বাদাম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে হৃদরোগর ঝুঁকিও কমায়। শর্করা বা গ্লুকোজ ও চর্বি নিয়ন্ত্রণে এর প্রভাব রয়েছে। পেস্তা বাদাম প্রোটিন, এন্টি অক্সিডেন্ট ও আঁশের একটি ভালো উৎস। এ কারণে এটি স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিস টাইপ-২ (ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নয়) যারা এ অবস্থান করছেন পেস্তা বাদামে থাকা স্বাস্থ্যকর তেল বিশেষত তাদের জন্য বেশি উপকারী।
কাজু বাদাম আমাদের হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অপরিহার্য কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড, পটাশিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ কাজু বাদাম যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে রয়েছে ফাইটোস্টেরল, ফেনোলিক যৌগ এবং ওলিক অ্যাসিড যা হার্টের স্বাস্থ্য এবং রক্তনালীগুলোকে মজবুত করে। কাজু বাদাম খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে এবং শরীরে ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) উন্নত করতে সহায়তা করে। এতে প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অভ্যন্তরীণ প্রদাহকে হ্রাস করে। ফলে, হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
কাজু বাদামে স্বাস্থ্যকর আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং খনিজ পদার্থ যেমন ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম এবং এল-আর্জিনিন থাকায় এটি আপনার রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে রক্তচাপকে ব্যাপকভাবে কমাতে সাহায্য করে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়েটে কাজু যুক্ত করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এটি ফাইবারের একটি ভালো উৎস, একটি পুষ্টি যা রক্তে শর্করার বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে। উচ্চ-ক্যালোরির কারণে, প্রতিদিন মাত্র ৩-৪ টি কাজু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কাজু বাদামে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক এবং ভিটামিন থাকায় শরীর সুস্থ রাখে। জিঙ্ক হলো একটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী যৌগ যা মৌলিক কোষ প্রক্রিয়ার জন্য অত্যাবশ্যক। নিয়মিত কাজু খেলে আপনাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে জিঙ্ক এবং ভিটামিন সরবরাহ করতে পারে যা শেষ পর্যন্ত আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সুস্থ হাড়ের জন্য আমাদের প্রচুর খনিজ প্রয়োজন। কাজু বাদামে এগুলো সবই আছে। কাজুবাদাম তামা এবং ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ যা আমাদের হাড়কে শক্তি দেয় এবং তাদের শক্তিশালী করে। তামা কোলাজেন সংশ্লেষিত করে গাঁটগুলোকে নমনীয় রাখতে সাহায্য করে।
আমাদের শরীরের মস্তিষ্ক সবচেয়ে সক্রিয় অঙ্গ যার সক্রিয় থাকার জন্য খাদ্যের মাধ্যমে ফ্যাটি অ্যাসিডের ক্রমাগত সরবরাহ প্রয়োজন। কাজু বাদামে মস্তিষ্কের সহায়ক পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলতে এবং আপনার স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে, আপনি রাতারাতি ভিজানো কাজু খেতে পারেন।
অনেকেরই ধারণা মুঠোভর্তি কাজুবাদাম খেলেই তরতরিয়ে বাড়বে ওজন। কাজুর মধ্যে ক্যালেরির পরিমাণ বেশি তা ঠিক, কিন্তু কাজু শরীরের একাধিক কাজে লাগে। কাজুর মধ্যে থাকে স্বাস্থ্যকর চর্বি, থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এসব কারণের জন্য কাজু স্বাদেও খাসা। মিড মর্নিং স্ন্যাকস হিসেবে ২ টো কাজু খেতেই পারেন। এতে বাড়বে না ওজন। বরং মুক্তি পাবেন একাধিক সমস্যার হাত থেকে। বিশেষত যারা হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার একদল বিজ্ঞানী এই গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন একমুঠো কাজুবাদাম গ্রহণে ক্যালরির ঘাটতি পূরণ হয়। লবণাক্ত এবং প্রক্রিয়াকৃত খাবার খাওয়ার প্রবণতা দূর করে। সেই সঙ্গে বাড়ায় প্রোটিনের কার্যকারিতা।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশে বিজ্ঞানীদের পরামর্শ, দৈনিক কাজুবাদাম খেলে স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন হয়। তিন সপ্তাহ ধরে চলা গবেষণায় দৈনিক ২৮ জুটির প্রত্যেককে দেড় আউন্স পরিমাণ কাজুবাদাম খেতে দেয়া হত। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেরই খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি ঘটেছে। সেই সঙ্গে ক্ষুধার্থ অবস্থায় জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তিও কমেছে।
কাজু বাদামের মধ্যে থাকে অ্যানাকার্ডিক অ্যাসিড। যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ইস্ট্রোজেন নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ভূমিকা রয়েছে এই কাজুবাদামের।
মহিলাদের শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল ইস্ট্রোজেন। শরীরে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণে ভারসাম্য না থারলে সেখান থেকে একাধিক সমস্যা আসতে পারে। হার্টের সমস্যা, হাড়ের সমস্যা এসব তো থাকেই। এছাড়াও ফাইব্রয়েড, পিসিওএস, ওজন বেড়ে যাওয়া, অনিয়মিত পিরিয়ডসের মত একাধিক সমস্যা বাড়ে। এক্ষেত্রেও কাজ দেয় কাজুবাদাম।
আজকাল মহিলাদের মধ্যে জরায়ু টিউমারের মত সমস্যাও বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হল ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের তারতম্য। ফাইব্রয়েডের কারণও কিন্তু এই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। এক্ষেত্রেও সুরক্ষা কবচ কাজুবাদাম।
একমুঠো কাজুর মধ্যে থাকে ২০ মিলিগ্রাম অ্যানাকার্ডিক অ্যাসিড। পিরিয়ডসের আগে যে পিএমএসের সমস্যা হয়, যাদের অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, জরায়ুতে ফাইব্রয়েড রয়েছে তারা পিরিয়ডের ১০ দিন আগে থেকে কাজু খান। স্তন ক্যানসার রুখেতও ভূমিকা রয়েছে কাজুর।
নাস্তা হিসাবে কাজুবাদাম খাওয়া হয় এবং বাদামের মিশ্রণেও ব্যবহৃত হয়। কাজুবাদামে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি, প্রোটিন এবং ফাইবার রয়েছে যা আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পাকস্থলিতে থাকে এবং আপনার শরীরে খাদ্য সরবরাহ করে । কিন্তু বাদামে যেহেতু ক্যালোরি বেশি, তাই পরিমিত পরিমাণে খাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কাজুবাদামে রয়েছে প্রাকৃতিক তেল যা সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এটি আপনার ত্বককে রাখে তরুণ ও সতেজ। তামা এলাস্টিন এবং কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। কোলাজেন একটি অবিচ্ছেদ্য কাঠামোগত প্রোটিন যা আপনার ত্বকের ইলাস্টিসিটির জন্য দায়ী।
কাজুতে উপস্থিত তামা চুলের রঙ্গক-মেলানিন তৈরিতে সাহায্য করে যা চুলের রঙ বাড়ায়। অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার চুলকে চকচকে এবং স্বাস্থ্যকর রাখে।
কাজুতে রয়েছে জেক্সানথিন এবং লুটিন যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ইউভি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রঙ্গকগুলি স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ে এবং ক্ষতিকর আলোর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে এবং বয়স-সম্পর্কিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (এএমডি) এবং ছানি হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
কাজু বাদাম জিঙ্ক সমৃদ্ধ যা পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা এবং প্রজনন সম্ভাবনা বৃদ্ধি করার জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, নিয়মিত কাজু খাওয়ার ফলে ওজন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে যা পুরুষের উর্বরতা বৃদ্ধি করে।