কোটি টাকার গরু ও ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিয়ে নানা প্রশ্ন

খানদানি বংশীয় গরু ছাগলের নামে সাদিক এগ্রোর ভয়ানক প্রতারণা

Any Akter
মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব
প্রকাশিত: ৩:১৫ অপরাহ্ন, ২৪ জুন ২০২৪ | আপডেট: ১১:২৩ অপরাহ্ন, ১৫ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

শত বছরের বংশীয় মর্যাদা সম্পন্ন গরু ও খানদানি ছাগলের নামে ভয়াবহ প্রতারণা করে কোরবানির বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আলোচিত সাদিক এগ্রো। নিজস্ব খামারে কিছু গরু ছাগল লালন পালন করলেও কুরবানির আগে বিভিন্ন বাজার থেকে গরু-ছাগল এনে নির্দিষ্ট সময়ে রাসায়নিক ঔষধ ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় মোটাতাজা করে বিক্রি করছে। সাদিক এগ্রোর প্রতারণা ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছে ভোক্তাসহ বিভিন্ন মহল।

ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার বহুল আলোচিত সাদিক এগ্রো। বহুদিন থেকে প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে পশু আমদানি ও বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ‘ খানদানি গরু’ ‘বংশীয় গরু’, ‘বংশীয় ছাগল’ গবাদী পশু বংশ মর্যাদা সম্পন্ন ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে এই খামারি। তারা আমাদানি নিষিদ্ধ ব্রাহামা প্রজাতির গরু জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করে বিতর্কের জন্ম দেয়। কৌশলে ফাঁকি দেয় সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর কাষ্টমস যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধভাবে আনা ১৮টি ব্রাহামা গরু জব্দ করে। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের নথিপত্র জাল করে সেই গরু আনা হয়েছিল। গরুগুলো সাভারে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে রাখা হলেও কৌশলে নিলামে আবার কিনে নেয় সাদিক এগ্রো। পশু নিয়ে নজিরবিহীন এই জালিয়াতিতে জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরাও এ নিয়ে মুখে এক রকম কুলুপ এঁটেছেন। 

আরও পড়ুন: বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ করা হয়নি উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদের হিসাব

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত ঈদুল আযহায় ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল ও কোটি টাকায় ব্রাহামা গরু বিক্রি করে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় সাদিক এগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইমরান হোসেন ছাগলটিকে ‘ খানদানি ছাগল’ হিসেবে প্রচার করেন। এই ছাগলের ক্রেতা ছিলেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের ছেলে মুসফিকুর রহমান ইফাত। ছাগলকাণ্ড নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছে ইফাত। এনবিআর পদ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাদিক এগ্রো মূলত: জালিয়াতি ও প্রতারণা করছে। তারা কোরবানি ঈদের এক দুই মাস আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেখতে সুন্দর গরু-ছাগল কিনে আনে। সেগুলোকে গরু মোটা তাজা করার জন্য নানান ধরণের হরমোন পুশ করে মোটাতাজা করে নানা কৌশলে কথা বলে বাজারে বিক্রি করে। 

আরও পড়ুন: খালেদা জিয়াকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

সাদিক এগ্রোর অবস্থান মোহাম্মদপুরে বছিলা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায়। ওই এলাকায় সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানান, সাদিক এগ্রো কিছু জমি ভাড়া নিয়ে এবং কিছু জমি অবৈধভাবে দখল করে বসানো হয়েছে। সারাবছর সেখানে গরু থাকে হাতে গোনা কয়েকটি। কিন্তু কোরবানি ঈদের এক দুই মাস আগ থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক ভর্তি গরু-ছাগল নামানো হয় সাদিক এগ্রোতে। সেই গরু চড়া দামে বিক্রি করা হয়।

জানা গেছে, এবারের কোরবানির ঈদের আগে সাদেক এগ্রো ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু বিক্রি করেছিল ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। এই গরুগুলোর ক্রেতার সঠিক নাম ঠিকানা প্রকাশ করেনি সাদিক এগ্রো। সাধারণ গরুর তুলনায় ব্রাহামাজাতের গরুগুলো কমপক্ষে ১৫ গুণ বেশি দামে বিক্রি করে সাদিক এগ্রো। এই প্রতিষ্ঠানটি আমদানি নিষিদ্ধ গরু এসে বংশ মর্যাদা সম্পন্ন ও খান্দানী, মা-বাবা ভালো, উন্নতজাত ইত্যাদি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরে ক্রেতাদের কাছে প্রতারণামূলকভাবে বিক্রি করে তারা। কোটি টাকায় গরু বিক্রি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গবাদি পশুর হাটে। সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরানের দাবি ১৪০০ কেজি ওজনের একটি গরু কোটি টাকায় বিক্রি করেন। একজন ক্রেতা এই হিসেব তুলে ধরে বলেন, প্রতিকেজি মাংসের দাম পড়েছে অন্তত: ৭ হাজার টাকা। সাধারণ ক্রেতাদের মতে এটা অন্যায় এবং ভোক্তাদের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণার শামিল। মাংসের বাজার অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। 

জানা গেছে, ২০১৬ সালে ব্রাহামা জাতের গরু আমদানি নিষিদ্ধ করে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর। এরপরও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের নথি জাল করে সাদিক এগ্রো ২০২১ সালের ৬ জুন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৩ থেকে ৬০ মাস বয়সী ১৮টি গরু আনে। ঢাকা কাস্টমস হাউস গরুগুলো জব্দ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করে। ওই গরুগুলো রাখা হয় সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে। পরে নিলামে আবার সেই গরুগুলো কিনে নেয় সাদিক এগ্রো। গরুগুলো রমজান মাসে জবাই করে সুলভমূল্যে বিক্রি করার শর্ত ছিল। কিন্তু সেটা না করে সাদিক এগ্রো গরুগুলো গত কোরবানির ঈদে কোটি টাকায় বিক্রি করে। 

সাদিক এগ্রোর ইমরানের উপস্থিতিতে একাধিক ভিডিওতে দেখা যায় কোটি টাকা দামের ব্রাহামা গরু বিক্রির পর ইমরান বলছেন, আজকে সাদিক এগ্রো থেকে বাংলাদেশের ওয়ান অ্যান্ড অনলি আমেরিকান পাখারা ব্রাহমন, হাইড সুপার ডুপার বিক্রি হল, ক্রেতা আমাদের বিলাভ-অ্যাট সাকের ভাই। সাকের ভাই এবার হজ্ব পালন করতে যাচ্ছেন। সবাই সাকের ভাইয়ের হজ কবুল হওয়ার দোয়া করবেন। অল দ্যা বেস্ট সাকের ভাই। আমিন ছুম্মা আমিন। 

ভিডিওতে দেখা যায় ওই সাকের আহমেদ ব্রাহামা দুইটা গরু (পিয়েল ও কমান্ডো) কিনেন। এছাড়া তিনি ভিডিও দুটিতে দুম্বা নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা করেন। এই সাকের আহমেদ কে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। একটি সূত্র জানিয়েছে তিনি তৈরি পোষাক খাতের ব্যবসায়ী, সিআইপি এবং একটি টেক্সটাইলস মিলসের মালিক। 

২০২১ সালে বিমানবন্দরে কাস্টমস যে গরুগুলো আটক করেছিল, সেগুলো কিভাবে ইমরানের নিজস্ব খামারে সাদিক অ্যাগ্রো পেয়েছে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের কৃত্রিম প্রজনন বিভাগের পরিচালক ডা. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্ধারিত ২৫টি স্থানে রমযান মাসে সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির জন্য আমরা প্রশাসনিক একটি নির্দেশনা পেয়ে গরুগুলো হস্তান্তর করেছি। পরে এই গরুগুলো জবাই করা হয়েছে কি না সেটি মনিটর করার দায়িত্ব আমাদের না। এটি মনিটর করার দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।

শুধু গরু নয় খাসি এবং অন্যান্য গবাদি পশুর বাজারেও নৈরাজ্য ছড়িয়ে প্রতারণা করেছে সাদিক এগ্রো। ৩০ কেজি ওজনের খাসি লাইভ ওয়েট ৭০০ টাকা ধামাকা অফার দেয়। তাদের একটি খাসি ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকে। কোরবানির ঈদের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হয়েছিল ১৮০ কেজি ওজনের একটি ছাগলের ভিডিও। সাদিক এগ্রোর খামারে থাকা পশুটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার খাসিটির দাম হাঁকা হয় ১৫ লাখ টাকা। 

সাদিক এগ্রোর ম্যানেজার জাহিদ হাসান বলেন, খাসিটি দিল্লি থেকে আনা। সচরাচর দেশে এত বড় ছাগল দেখা যায় না, তাই এর দাম অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি। পরে জানা যায়, কোরবানির দুই মাস আগে ছাগলটি যশোরের একটি হাট থেকে কিনে খামারে তোলে সাদিক এগ্রো। সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান নিজে দাবি করেন, ‘যশোর থেকে ১০ লাখ টাকা কেনা হয়েছিল ছাগলটি।’ তার এই দাবিও অসত্য ও প্রতারণামুলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এদিকে সাদিক এগ্রোর প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক  বলেন, ‘উনি খামারি। তার সঙ্গে আমাদের ডিসকোর্স (নানা বিতর্ক) আছে। তিনিসহ অনেকেরই ব্রাহামার প্রতি আসক্তি আছে। আমরা ব্রাহামা আমদানির পক্ষে নই। কারণ ব্রাহামা দুধ খুব কম দেয়। তবে সাদিক এগ্রো কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, গবাদি পশু নিয়ে আরও সতর্কভাবে বক্তব্য দেওয়া। তিনি বংশীয়, খান্দানী এসব শব্দ ব্যবহার না করে ‘উন্নত জাত’ বলতে পারতেন। তিনি কোরবানির বাজারে যে দাম হাঁকিয়েছেন একটি গরুর এত উচ্চমূল্য অস্বাভাবিক। বর্তমান সরকার যেখানে ভোগ্য পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে, সেখানে গরুর এই দাম স্বাভাবিক বাজারমূল্যের মধ্যে পড়ে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও কম মূল্যে ভ্রাম্যমাণ মাংস বিক্রি করে। সাধারণ মানুষ যাতে সুলভ মূল্যে মাংস কিনতে পারে, এ জন্য সরকারের সব ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। আর সেখানে সাদিক এগ্রোর এত চড়ামূল্যে গরু বিক্রি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সাদিক এগ্রোর বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, মাংসের এ ধরনের অস্বাভাবিক দাম সাধারণ বাজারে প্রভাব ফেলে।

এ বিষয়ে সাদেকের প্রসত্বাধিকারী ইমরান হোসেনের  মোবাইলে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বাংলাবাজার পত্রিকার প্রতিবেদক পরিচয় ক্ষুদ্র বার্তা মোবাইলের দেয়া হলেও তিনি কোন প্রকার মেসেজের উত্তর দেননি।