বৈঠকের পুরো অডিও রেকর্ড খতিয়ে দেখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

পুলিশের গোপন বৈঠক নিয়ে তোলপাড়

Any Akter
বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাবাজার পত্রিকা
প্রকাশিত: ১১:৫০ অপরাহ্ন, ২২ মার্চ ২০২৫ | আপডেট: ১০:৫২ পূর্বাহ্ন, ২৩ মার্চ ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
  • অংশগ্রহণকারীদের কৈফিয়ৎ তলব ও বদলির প্রস্তাব

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে চাপা অসন্তোষ বিরাজমান। পুলিশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তার গত শুক্রবার এক গোপন বৈঠক  নিয়ে চলছে তোলপাড়।। গোয়েন্দা দের দেয়া ওই বৈঠকের পুরো  অডিও ভিডিও  রেকর্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে খতিয়ে দেখছে। বৈঠকে যোগ দেওয়া পুলিশ কমিশনার রেঞ্জ ডিআইজি সহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী পুলিশ সুপারদের ব্যাখ্যা তলব করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার।      সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায় গত সাত মাসেও পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পারা, বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা, অভ্যুত্থান পরবর্তী যোগ্য অভ্যুত্থান সমর্থিত ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা না থাকায় নেতৃত্ব নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে অসন্তোষ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে পুলিশ হেড কোয়াটারের দুইজন অতিরিক্ত ডিআইজি পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে গত শুক্রবার সকল ব্যাচের প্রতিনিধিদের নিয়ে অফিসার্স ম্যাচে আলোচনা সভা ও ইফতারের আয়োজন করে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিআইজি প্রশাসন কাজী ফজলুল করিম এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার ডঃ,নাজমুল করিম খান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদ, এসবির ডিআইজি মীর আশরাফ রংপুর রেঞ্জ র ডিআইজি আমিনুল ইসলাম সহ পুলিশের ১৫  থেকে চলমান ৪১ তম ব্যাচের দুই তিন জন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সভায় অংশগ্রহণকারী একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে জানা যায় মূলত পুলিশে কাজের গতি ফিরিয়ে আনতে ও নেতৃত্ব শক্তিশালী করতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্যই বক্তব্য রাখেন।

আলোচনায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় গূম খুন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিপীড়নের অভিযোগে বিচারাধীন ও শাস্তি প্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শূন্য পদে যোগ্য লোকদের দ্রুত পদায়ন করে গতিশীল করার আলোচনা করা হয়। পুলিশের বর্তমানে ১৯ টি অতিরিক্ত আইজিপির শূন্য পদ ও তার দ্বিগুণ ডিআইজি পদ ও অন্যান্য পদেও শূন্য থাকলেও কোনো পদোন্নতি বা নিয়োগের উদ্যোগ না নেওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত ও  যোগ্য লোকদের পদায়ন নিয়ে ধীরগতি ও সিদ্ধান্তহীনতায় পুনর্গঠনে অসন্তোষ প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ী করা হয়। বৈঠকে অংশ নেয়া একজন কর্মকর্তা জানান ডিআইজি এডমিন সাহেবের উপস্থিতির খবরে বৈঠকে যাই, সেখানে পুলিশের কাজে আরো ভালো করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা আহ্বান জানানো হয়।

ডিআইজি অ্যাডমিন বৈঠকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারকে সর্বাত্মতা সহায়তা করতে পুলিশকে আরো শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। বৈঠকে যোগ দেওয়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে জানা যায় মূলত গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বঞ্চিত ও অভ্যুত্থানে ভূমিকা নেওয়া কর্মকর্তারা ইফতারে মিলিত হয়েছিলেন।

সেখানে অধিকাংশ বক্তা পুলিশকে আরো শক্তিশালী কার্যকর ভূমিকা রাখার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য জোরালো বক্তব্য রাখেন। এখানে পুলিশ প্রধান বা সরকারের কারো সমালোচনা করা হয়নি। এমনকি কোন দলীয় বা গোষ্ঠী বা পুলিশ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থের বিষয়ও  আলোচনা হয়নি ।

কিন্তু বৈঠকের পরপরই বৈঠকে থাকা কেউ অথবা গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টিকে নানা রং লাগিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে মিসগাইড করতে পারে। এর পরই শুরু হয় পুলিশের অর্ধতন কর্তৃপক্ষের তৎপরতা। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের প্রশাসন ও পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে বৈঠকে যোগদানকারীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলা হলেও ঢাকার বাইরে থেকে যারা যোগদান করেছেন তাদেরকে বিনা অনুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগের অভিযোগ এনে শৃঙ্খলা পরিপন্থী হিসাবে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। আইজিপি বাহারুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে তিনি নিজেই নোটিশ দিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ডঃ নাজমুল করিম খানকে। 

গত ১৬ মার্চ ব্যাখ্যা তলব প্রসঙ্গে এক চিতিতে বলা হয় আপনি ডক্টর নাজমুল করিম খান পুলিশ কমিশনার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ হিসেবে কর্মরত আছেন। আপনি গত ১৪/০৩-২৫ তারিখে পুলিশ অফিসারস ম্যাচ ঢাকায় ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গাজীপুর আপনার ডিউটি স্টেশন ছেড়ে ঢাকায় আসার জন্য আপনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অনুমতি নিয়েছেন এমন কোন রেকর্ড নেই। আপনার এহেন আচরণ শৃঙ্খলা পরিপন্থী এবং অসাদা চরণের শামিল। এজন্য কেন আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হবে না তার লিখিত জবাব অত্রপত্র প্রাপ্তির তিন কার্য দিবসের মধ্যে দাখিল করতে আপনাকে নির্দেশ প্রদান করা হলো।

একই ধরনের ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এর পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট এক শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি শামীম আসমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে। গাজীপুর নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার সহ বৈঠকে যোগদানকারী ঢাকার বাইরের কর্মকর্তাদের।

পুলিশ সদর দপ্তর চিঠিতে ইফতারিতে যোগদান করা উল্লেখ করলেও অনুসন্ধানে জানা যায় দীর্ঘদিন ধরেই গাজীপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকার উত্তরা ও রাজধানীতে বসবাস করেন।

অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ নরসিংদী ঢাকা মানিকগঞ্জ পার্শ্ববর্তী এলাকার পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকা শহরে অবস্থান করে অফিস পালন করেন। গাজীপুর মেট্রোর কর্মকর্তাদের আবাসনের কোন ব্যবস্থা নেই। ইফতারিতে যোগ দেওয়া নিয়ে হঠাৎ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ ধরনের চিঠি নিয়ে পুলিশের তোলপাড় শুরু হয়েছে। এছাড়াও বৈঠকে যোগ দেওয়া আরও দুই ডিআইজিকে ঢাকার বাইরে বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায় ৫ আগস্ট পরবর্তী কর্মস্থল ছেড়ে যাওয়া পুলিশকে সু সংগঠিত করে কাজে ফেরাতে বৈঠকে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারাই গুরুতর ভূমিকা পালন করেন। 

এ বিষয়ে পুলিশের আইজিপির সরকারি নাম্বার ও ডিআইজি প্রশাসনের সরকারি নাম্বারে বারবার ফোন ও মেসেজ দিলেও তারা কোন সাড়া দেননি। ফ্যাসিস্ট শাসকের পক্ষে রক্তাক্ত যুদ্ধে পরাজিত পুলিশ সদস্যরা  কাজে যোগ দিলেও অনেকটা কিংকর্তব্যবহার।

কয়েকশো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা আটক এমন কি কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার ও প্রতি দিনই হুমকি ও নানা ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। গত সাত মাসেও পুলিশকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করতে না পারায় সর্বমহলেই আলোচিত হয়। অনুসন্ধানে জানা যায় বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলম দায়িত্ব নেওয়ার পরেই তার বাসা এবং অফিসে পূর্ব নির্ধারিত অনুমতি ছাড়া কর্মকর্তাদের যেতে অফিসিয়ালি নিষেধ করেছেন।

অতিরিক্ত আইজিপি সহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এজন্যে খোলামেলা আলোচনা করতে ইতস্তত থাকেন। দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত আইজিপি যোগদানের প্রথম দিনেই পরিচিতি বৈঠকে একজন অতিরিক্ত আইজিপি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে পুলিশের ডিসিপ্লিন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আর যাতে চুক্তি না হয় সে বিষয়ে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ জানান।

পুলিশের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে  চাকুরীতে স্বাভাবিক অবসরে নেওয়া ডিআইজি বাহারুল আলম কে দুই বছরের চুক্তিতে আইজিপি ও শেখ সাজ্জাদ আলী কে দুই বছরের চুক্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিয়োগ করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পরেও তাদের সততা নিয়ে কোন প্রশ্ন না উঠলেও পুলিশকে আন্তরিকতার সাথে কাজে সক্ষমতা তৈরিতে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে।