সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দেশনা দেয়

ডাকসু জাকসুতে শক্তির মহড়ায় সহিংসতার শঙ্কা বাড়লেও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৮:২৯ অপরাহ্ন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:০৫ অপরাহ্ন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দুই দলের শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় সহিংসতার শঙ্কা বাড়লেও অবশেষে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ ও ফলাফলের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

ডাকসু নির্বাচনের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে মার-মুখি পরিস্থিতি ও ভয়াবহ সহিংসতার আশঙ্কা করা হলেও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনের পরেও পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়।

আরও পড়ুন: ব্রিটিশ গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার আমলে অর্থপাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ

একই অবস্থা হয় জাকসু নির্বাচনে। ছাত্রদলসহ পাঁচটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করলেও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামাতের নেতারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান করে মহড়া প্রদর্শন করলেও সহিংসতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

সরকারের প্রচেষ্টায় ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান সফল হয়, যার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের মডেল টেস্ট। একই কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

আরও পড়ুন: মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারেক রহমান

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ভয়াবহ সহিংসতার শঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রনেত্রীবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে তিনজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তারা সার্বক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। ফলে ৯ তারিখ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারপাশে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া চললেও সরকার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

গত ৯ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সেদিন দুপুরের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পয়েন্টে থাকা প্রবেশমুখে অবস্থান নিতে থাকেন জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তাদেরকে দিতে শোনা যায় নানা ধরনের দলীয় স্লোগানও। এদিকে ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলেও অভিযোগ তোলেন কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীরা।

সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে দুই দলের নেতাকর্মীরা পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো ঘটনা ছাড়াই নির্বাচন শেষ হয় এবং ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তবে প্রবেশপথে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের অবস্থান নিয়ে ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসলে বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে।

অনেকটা একই দৃশ্য দেখা যায় দুইদিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ – জাকসু নির্বাচনেও। নির্বাচনের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের দেখা হবার কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা। পরদিন নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ তোলে কয়েকটি প্যানেল। বিকেলের পর থেকে ডাকসু নির্বাচনের মতো একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে অবস্থান নিতে দেখা যায় জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের।

এরমধ্যে মূল ফটকের বাইরে চায়ের দোকানগুলোতে অবস্থান নেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা, আর পেছনের দিকের ফটকের বাইরে অবস্থান নেন বিএনপি-ছাত্রদলের সাবেক নেতাকর্মীরা। দিনব্যাপী ছড়ায় সংঘাত-সংঘর্ষের আতঙ্ক, উদ্বেগ তৈরি হবার কথা জানান শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাস্টার্সে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থী জানান, "এটা নিয়ে খুবই আতঙ্কিত ছিল শিক্ষার্থীরা। অনেকেই মনে করছিল বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয় কি না"।

রাত দুইটার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে আসেন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা-১৯ আসনের এমপি প্রার্থী আফজাল হোসাইন। এনিয়ে খবরও প্রকাশ হয় কয়েকটি গণমাধ্যমে। আর ওই ফটকের পাশেই নারী শিক্ষার্থীদের একটি হল থাকায় উদ্বেগের কথা জানিয়ে ফেসবুকে তাদের অনেকে পোস্ট দেন বলেও জানান ওই শিক্ষার্থী।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতা-কর্মীদের অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে পরস্পরকে দুষছেন শিবির ও ছাত্রদল সভাপতি।

এবিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জানান, কোনো বহিরাগত যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে করতে না পারে তা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আগে থেকেই বারবার বলা হয়েছিল। কিন্তু গণমাধ্যম মারফত 'বহিরাগত প্রবেশের' কথা তারা জানতে পারেন আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এই বিষয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সে জায়গায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি নাই। কিন্তু আমাদের নেতাকর্মীরা পলিটিক্যাল গ্রাউন্ড (রাজনৈতিক বিবেচনায়) থেকে মূলত সেখানে উৎসুক জনতার মতো করে তারা সেখানে গিয়েছে", বলেন তিনি।

এর মাধ্যমে বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকে বিএনপি ও ছাত্রদলের সাবেক নেতারা নির্বাচনের "পরিবেশ নষ্ট করার" পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলেও দাবি করেন মি. ইসলাম।

একই ঘটনা ডাকসুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, আগের রাত থেকেই ছাত্রদলের সাবেক নেতাকর্মী এবং যুবদলের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। ডাকসু নির্বাচনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকের এলাকায় বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মিছিল করার কথাও জানান তিনি।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব। এমন দাবিকে "সরাসরি তাদের মুনাফেকি চরিত্র" বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার দাবি, ডাকসু নির্বাচনের সময় সকাল থেকেই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে দলটির ঢাকা শহরের সব লোকবল নিয়ে "পূর্বপরিকল্পিত" এবং "উদ্দেশ্যমূলকভাবে" সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল।

"ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিলেটেড কিছু শিক্ষার্থী কিন্তু ভোটার না এমন কয়েকজন নেতাকর্মীকে শাহবাগে আমি আড্ডা দিতে দেখেছি। তারা আশেপাশে ছিল। সেটা রাতের বেলা", বলেন মি. রাকিব। তবে দলীয়ভাবে অবস্থান নেয়ার কোনো নির্দেশনা বিএনপি-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের দেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। বরং জামায়াত-শিবিরের অবস্থান দেখে নীলক্ষেতের দিকে বিএনপির যেসব নেতাকর্মীরা স্বেচ্ছায় জড়ো হয়েছিলেন তাদেরও শোডাউন না করার ব্যাপারে শীর্ষ পর্যায় থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল।

জাকসুর ক্ষেত্রেও সেখানে বিএনপি-ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী ছিল না বলে দাবি করেন তিনি। উল্টো ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরে একটি রাজনৈতিক দলের 'মহড়া' দেবার এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অবশ্য শিবির সভাপতি বলছেন, গত ১৫ বছর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নির্বাচন হলেও তা নিয়ে উৎসুক জনতার আগ্রহ ছিল। সে জায়গা থেকে সাধারণ মানুষরা এসেছে, সেখানে হয়তো আমাদেরও কোনো কোনো নেতাকর্মী আসতে পারেন। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতাভবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কেউ প্রবেশ করেনি, বলেন তিনি।

একইসাথে বিএনপি যেভাবে মিছিল করে শক্তি প্রদর্শন করেছে আমাদের জায়গা থেকে সেটা আপনি প্রমাণ পাবেন না, সেধরনের খুব বেশি কিছু হয়েছে" বলেও মন্তব্য করেন মি. ইসলাম।

দুই ছাত্র সংসদ নির্বাচনেই জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অবস্থানকে "সহিংসতার আশঙ্কা থেকে শক্তি প্রদর্শন" হিসবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তার মতে, মোটাদাগে এধরনের কর্মকাণ্ডের মূল ভাবনাই থাকে প্রতিপক্ষকে বার্তা দেয়া যে "তুমি যদি আমাকে অ্যাটাক (আক্রমণ) করো, তাহলে আমরাও কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না"।

তারা হয়তো মনে করে যে যদি কোনো অ্যাটাক (আক্রমণ) হয়, তাদের ওপর, তারা যেন নিজেরা তা প্রতিরোধ করতে পারে। সেজন্যই এই ধরনের শোডাউন করে বলে আমার মনে হয়, বলেন তিনি।