নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী সুবিধাভোগী ৪ ডিসি নিয়োগে নানা প্রশ্ন

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও ইউএনও নিয়োগে বিতর্ক লেগেই আছে। জেলা প্রশাসক নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেন মারামারি হামলা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ছিল নিত্যদিনের। প্রশ্ন হল মোখলেসুর রহমানকে সরিয়ে নতুন জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগ দিলেও আবারো কেন নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্মকর্তা ও মন্ত্রী মর্যাদায় ব্যক্তির এপিএস কিভাবে জেলা প্রশাসক নিয়োগ হয়। বহুল আলোচিত মোখলেস সিন্ডিকেট এ মোটা অংকের টাকা দিয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক নিয়োগ নানা আলোচনা হচ্ছে।ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে।সততা দক্ষতা ও গণঅভ্যুত্থান চেতনা বিবেচনা না করেই গুরুত্বপূর্ণ এডিসি নিয়োগ নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ ৪ আওয়ামীসুবিধাভোগীকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক আজ
বুধবার (১৫ অক্টোবর) মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার উপসচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই নিয়োগ দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার কার্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক ও বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সোলাইমানকে চাপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মিজ আফছানা বিলকিসকে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মিজ মনিরা হককে ফেনীর জেলা প্রশাসক, ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পুনর্ব্যক্ত
জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চাপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া মোহাম্মদ সোলাইমান আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। চাকুরি জীবনের শুরুতেই সহকারী কমিশনার থাকা অবস্থায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে পদায়ন করে আওয়ামীলীগ সরকার। পরবর্তীতে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মাত্র ৬ মাস মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপ পরিচালক হিসেবে। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপের নামে প্রায় তিন কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান। সেখান থেকে ফিরে যোগদেন শিল্প মন্ত্রণালয়ে। ২০২৪ সালে পদায়ন নেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে। অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তাকে রাজউক থেকে সরিয়ে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের একটি প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। মাত্র আড়াই মাস দায়িত্বপালন করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে বিদ্যুৎ বিভাগে পদায়ন নেন।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া আফছানা বিলকিস ছিলেন আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সাবেক পানি সম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সাথে বিশেষ সখ্যতা থাকায় তার সাথে একই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন ৫ বছর। কবির বিন আনোয়ার মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে অবসরে যাওয়ার পর তাকে এইচটি ইমামের স্থলাভিষিক্ত করে শেখ হাসিনা। এছাড়াও এই কর্মকর্তা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, চট্রগ্রামের হাট হাজারি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জাতীয় সংসদের সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মিজ মনিরা হককে। এই কর্মকর্তা পালিয়ে যাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ থেকে দীর্ঘ ৫ বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপুর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন। ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩০ জন পর্যন্ত সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সংবেদনশীল ইমিগ্রেশন শাখায় কাজ করেছেন।
এছাড়াও মনিরা হক গাজীপুরের সহকারী কমিশনার, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), ফেনীর সিনিয়র সহকারী কমিশনার, পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেছেন।
চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে । সাইফুল ইসলাম আওয়ামী শাসনামলে অর্থ বিভাগ, বাগের হাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, একই জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করেছেন।
আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা ফেনীর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেই এক আওয়ামীলীগ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের এম সাখাওয়াত হোসেন খান ২০২৩ সালে কাতার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তার আগে থেকেই তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পদায়নের জন্য জনপ্রশাসনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। এই সিন্ডিকেটে জড়িতদের বেশিরভাগই আগে থেকেই জনপ্রশাসনে পদায়ন ছিলেন। এছাড়াও শেখ হাসিনার সরকারের সুবিধাভোগী কয়েকজন কর্মকর্তা যারা সেই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ছিলেন এখন দল পাল্টে বিএনপিপন্থী বলে পরিচয় দিচ্ছেন এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন। সেই সিন্ডিকেটটি মূলত অফিসার্স ক্লাব কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন। ক্লাবের প্রভাবশালী একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এসব পদায়নের তদবির করেন। তাদের এই তদবির বাস্তবায়ন করাই প্রধান টার্গেট থাকে সিন্ডিকেটের। ফলে আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা এখনও ডিসি হিসেবে পদায়ন পাচ্ছেন।
এর গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর নিয়োগ দেওয়ার পর বিভিন্ন অভিযোগে ৮ জেলার ডিসি পদে নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিল। এরা হলেন, লক্ষ্মীপুরে নিয়োগ পাওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপ-সচিব সুফিয়া আক্তার রুমী, জয়পুরহাটে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি ২-এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপ-সচিব) মো. সাইদুজ্জামান, কুষ্টিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ফারহানা ইসলাম, রাজশাহীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. মাহবুবুর রহমান, সিরাজগঞ্জে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মনির হোসেন হাওলাদার, শরীয়তপুরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ সচিব আব্দুল আজিজ, দিনাজপুরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোবাশশেরুল ইসলাম, রাজবাড়ীতে আরপিএটিসির উপ-পরিচালক মনোয়ারা বেগমকে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।