কমিশনে মাঠ পুলিশদের প্রতিনিধি, সরাসরি এএসআই নিয়োগ বন্ধ ও ৫০% এএসপি পদোন্নতির দাবি

নতুন অধ্যাদেশে দায়মুক্তি চায় পুলিশ

Sanchoy Biswas
মুস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব
প্রকাশিত: ৯:৫৪ অপরাহ্ন, ২২ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১০:৪৬ অপরাহ্ন, ২২ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য নতুন পুলিশ অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করেছে সরকার। আইন মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত ব্যাটিং শেষে রাষ্ট্রপতি এ মাসেই অধ্যাদেশ জারি করবে বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে অধ্যাদেশে দায়িত্ব পালনের সুরক্ষাসহ  কিছু সংশোধনী আনতে দাবি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশন৷ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা প্রায় আড়াই লাখ পুলিশ সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ এ মাসেই দেখা করেন আইজিপি বাহারুল আলমের সাথে। পুলিশ প্রতিনিধিরা তাদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন আইজিপির কাছে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন চূড়ান্তের খসড়া দেখে পুলিশ নেতৃবৃন্দ আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া পুলিশ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক ডাবলু বলেন, স্বাধীন পুলিশ কমিশনের আওতায় আমরাও কাজ করতে আগ্রহী। তবে এতে মাঠ পুলিশের কিছু বিষয় নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত ৯ সদস্যের কমিশনে মাত্র দুইজন পুলিশ প্রতিনিধি। আমরা আড়াই লাখ পুলিশের পক্ষ থেকে নন ক্যাডার থেকে একজন সদস্য রাখার দাবি করছি।  পেনাল কোডের ৭৬ থেকে ১০৬ ধারায় দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট সুরক্ষা নেই। বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশকে বৃদ্ধ বয়সে মামলার আসামি হতে হচ্ছে। পুলিশ দায়িত্ব পালনে স্বাধীন কমিশনের নতুন আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা চায়। পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন মামলা করা যাবে না। কেউ ভিকটিম হলে কমিশনে আবেদন করবে এরপর তদন্ত শেষে মামলা করবে। স্বাধীন আইনিভাবে দায়িত্ব পালন করতে এটি আমাদের সুরক্ষার দাবি।

পুলিশের দুই লাখেরও বেশি কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করে। তাদের জীবনের একটাই প্রত্যাশা এএস আই পদোন্নতি পাওয়া। কিন্তু সম্প্রতি স্বরাষ্ট  মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি ৪০০০ নতুন এএসআই নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সরাসরি নিয়োগ বন্ধ করে পদোন্নতির মাধ্যমে  নিয়োগ দিলে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা নতুন উদ্যমে কাজ করবে। আইনে থাকলেও সরকারি পুলিশ সুপার পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫০% কোটা রক্ষা করা হচ্ছে না। এই ধরনের নৈতিক দাবি পুলিশ সদস্যদের কল্যাণমূলক করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর  সূত্র জানা যায়, আইজিপিসহ বাহিনীতে প্রায় আড়াই লাখ সদস্য কর্মরত থাকলেও মাত্র হাজারের মতো বিসিএস কর্মকর্তা। বেশিরভাগই কনস্টেবল ও এসআই থেকে নিয়োগ হয়ে পদোন্নতি প্রাপ্ত। কিন্তু আইনে বেশিরভাগ সুযোগ সুবিধা ক্যাডার কর্মকর্তারা ভোগ করেন। মাঠ পর্যায়ে কঠোর দায়িত্ব পালন করে বিভিন্ন দায় নিয়ে থাকতে হচ্ছে অধস্তনদের। এ থেকে সুরক্ষা চায় পুলিশ সদস্যরা।

আরও পড়ুন: শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাসে স্মরণীয় দিন: প্রধান উপদেষ্টা

পুলিশ এসোসিয়েশন দাবি প্রসঙ্গে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ বাহারুল আলম বাংলাবাজার পত্রিকাকে জানান, এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ তাদের দাবিগুলো আমাদের বলেছে। এই মুহূর্তে এগুলোর কিছু করার নেই।  যেহেতু স্বাধীন পুলিশ কমিশনের একটি কাজ চলছে। এরপরে তাদের দাবিগুলো পরবর্তী আইনিভাবে দেখা যেতে পারে। স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের চূড়ান্ত কিছু হওয়া আমার জানা নেই। এটি নিয়ে কাজ চলছে।  আগে অধ্যাদেশ আসুক এরপর পুলিশের দাবিগুলো কার্যাবলি আকারে আসতে পারে।  তবে স্বরাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের পুলিশ উইং সূত্রে জানা যায়, গত ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় এই অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এখন এটি আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করতে পরবর্তী প্রশাসনিক উদ্যোগ নেবে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করার পরই সরকার কাক্ষিত পুলিশ কমিশন গঠন করবে।

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, ‘পুলিশ কমিশন’ নামে এই সংস্থাটি হবে একটি সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কমিশনের নিজস্ব দপ্তর, বাজেট ও জনবল থাকবে এবং এটি সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কমিশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হবে ঢাকায়। নতুন কমিশনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, অভিযোগ তদন্ত এবং প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ; নাগরিক অভিযোগ ও পুলিশ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ; নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও পরামর্শ প্রদান; পুলিশের আইনানুগ কার্যক্রমে কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা বিধিবহির্ভূত বা অযাচিত প্রভাব বিস্তার করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ বা সুপারিশ প্রদান, আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বলপ্রয়োগ সংক্রান্ত পুলিশি কার্যক্রমের নিয়মিত নিরীক্ষা, আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পুলিশ গঠনে সুপারিশ প্রদান; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পুলিশি কর্মকাণ্ড তদারকি, জনআস্থা বৃদ্ধির জন্য গণশুনানি ও পরামর্শ সভা আয়োজন; পুলিশের কার্যক্রম ও জননিরাপত্তা সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ। 

আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কিছু উপদেষ্টার ভূমিকায় আপত্তি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী

কমিশন গঠন ও কাঠামো

কমিশনে মোট ৯ জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান, একজন সদস্য সচিব এবং আরও সাতজন স্থায়ী সদস্য। চেয়ারম্যান হবেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আর সদস্য সচিব হবেন অবসরপ্রাপ্ত একজন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা।

সদস্যদের মধ্যে থাকবেন- জাতীয় সংসদের সংসদ নেতার প্রতিনিধি (অস্থায়ী সদস্য), বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধি (অস্থায়ী সদস্য), সচিব পদমর্যাদার নিচে নন- এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার নিচে নন- এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, জেলা জজ বা খ্যাতনামা আইনজীবী (যিনি অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন), বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ের একজন অধ্যাপক, একজন খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী (যাঁর অন্তত ১৫ বছরের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে)।

প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে- কমিশনে অন্তত একজন নারী সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক। স্থায়ী সদস্যরা বেতনভুক্ত হবেন, তবে অস্থায়ী সদস্যরা অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

নিয়োগ ও মেয়াদ

রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশে নিয়োগ পাবেন কমিশনের সদস্যরা। তাঁদের মেয়াদ ৫ বছর। বাছাই কমিটি হবে পাঁচ সদস্যের, যার সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি (প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত), জাতীয় সংসদের স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত একজন অধ্যাপক।

কমিশনের চেয়ারম্যানের মর্যাদা হবে আপিল বিভাগের বিচারপতির সমান এবং সদস্যদের মর্যাদা হবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমান। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি বা পদ শূন্য থাকলে, কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য কার্যভার পালন করবেন।

অযোগ্যতা ও অপসারণের বিধান

দেউলিয়া, ঋণখেলাপি, দ্বৈত নাগরিক, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত, দুর্নীতি বা অসদাচরণের কারণে বরখাস্ত এমন কেউ কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা, স্বার্থগোপন বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সদস্যকে অপসারণ করতে পারবেন।

অভিযোগ অনুসন্ধান ও নিষ্পত্তি

পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিক অভিযোগের ন্যায়সঙ্গত তদন্ত ও সমাধান নিশ্চিত করবে কমিশন। নাগরিকদের অভিযোগের তদন্ত, বিভাগীয় কমিটি গঠন, অভিযোগকারীর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও প্রদান করবে কমিশন।

পুলিশ সদস্যদের ক্ষোভ নিরসন

পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, বৈষম্য, পদোন্নতি বা পদায়ন সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কমিশন সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে। প্রয়োজনে বিভাগীয় বা রেঞ্জ পর্যায়ে কমিটি গঠন করবে।

নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, কমিশন পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও মানদণ্ড নির্ধারণে সরকারের কাছে দিকনির্দেশনা দেবে। কমিশন সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটিতে অতিরিক্ত আইজিপিকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা প্রদান করবে এবং দক্ষ, পেশাদার ও প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গঠনে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।

পুলিশ প্রধান (আইজিপি) নিয়োগে সুপারিশ

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ পদে নিয়োগের জন্য সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সন্তোষজনক চাকরির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপির নিম্নপদস্থ নন এমন তিন (তিন) জন কর্মকর্তার একটি প্যানেল সরকারের নিকট সুপারিশ করবে কমিশন। নিয়োগপ্রাপ্ত আইজিপির মেয়াদ হবে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর।

প্রশিক্ষণ, কল্যাণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন

আধুনিক পুলিশিং, সাইবার নিরাপত্তা, ফরেনসিক, আইটি, ও মানবিক আচরণভিত্তিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সুপারিশ; নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে দিকনির্দেশনা দেবে প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন। এ ছাড়া পুলিশ আইন, ফৌজদারি আইন, রেগুলেশন, প্রবিধান ইত্যাদির পর্যালোচনা ও সংস্কারের প্রস্তাব করবে। জনগণ-পুলিশ আস্থা বৃদ্ধিতে প্রস্তাবিত কমিশনে গণশুনানি, পরামর্শসভা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম আয়োজন করে পারস্পরিক বিশ্বাস পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে অধ্যাদেশের খসড়ায়।

বার্ষিক প্রতিবেদন ও জবাবদিহিতা

প্রতি বছর কমিশন একটি বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করবে, যেখানে তাদের কর্মকাণ্ড, সুপারিশ ও সাফল্যের বিবরণ থাকবে। এই প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে এবং তিনি তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য স্পিকারের কাছে পাঠাবেন।

বিশেষ দায়িত্বে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে গেলে বা কার্যকর না থাকলে রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে চারজন অস্থায়ী সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন।