আলোচনায় গুরুত্ব নেই সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়
প্রার্থী ঘোষণা করে সারাদেশ নির্বাচনমুখী করার কৌশল বিএনপি’র
রাজনীতিকে নির্বাচনমুখী করার একটি ‘কৌশল’ থেকে বিএনপি এসপ্তাহে তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এর কিছুদিন আগেও সংস্কার, এর বাস্তবায়ন কীভাবে––এসব নীতিগত আলাপ জোরালো ছিল, এরপর তাতে অনেকটাই ভাটা পড়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে সরকারের বেঁধে দেওয়া সাত দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়ারও কোনো ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ‘জুলাই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক সহযোগিতা না পাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ভুল হয়েছে’
যদিও দলগুলোর মতবিরোধ দূর করতে সরকারের দেওয়া সময়সীমাকে সুযোগ হিসেবে দেখছে জামায়াতে ইসলামী।
সংস্কারের সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়েই দলগুলোর মতবিরোধ দেখা যায়। সেই মতবিরোধ মেটাতে দলগুলোকেই সময় বেঁধে দেওয়ার বিষয়কে সরকারের ‘কৌশল’ বলে মনে করেন রাজনীতিকদেরই অনেকে।
আরও পড়ুন: নির্বাচনী জোয়ার চলছে, সংশয় ছড়াচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর: প্রেস সচিব
তাদের কেউ কেউ সরকারের কৌশলকে ‘সাপ লুডু’ খেলার সঙ্গে তুলনা করছেন, আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ‘ব্যর্থতার দায়’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেও দেখছেন।
তবে দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কৌশলে রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
এমন পটভূমিতে প্রশ্ন উঠছে, রাজনীতি যখন নির্বাচনমুখী, তখন দলগুলো কি সংস্কার বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে সমাধানে আসতে পারবে?
আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় মতপার্থক্য দূর করা যায়নি। এখন সাতদিনেই কি তা সম্ভব-এই প্রশ্নেও রয়েছে আলোচনা।
রাজনীতির দৃশ্যপটে বিএনপির ‘কৌশল’
অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া সময়সীমা নিয়ে বিএনপির নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু দলটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
বিএনপি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভিন্নভাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যেদিন রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের সনদ বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেওয়া হয়, সেদিনই বিএনপি তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে।
এটিকেই দলটির ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘ আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কারের সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ দেয়, সেই সুপারিশে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত উল্লেখ করা হয়নি।
ফলে ওই সুপারিশ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতৃত্বের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হয়। তাদের সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ও ঐকমত্য কমিশন।
যদিও জামায়াতসহ আরো কিছু দল কমিশনের সুপারিশের সমর্থনে অবস্থান নেয়, কিন্তু দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করে।
আর এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি সভা করা হয় গত তেসরা নভেম্বর। সেই বৈঠকে দলগুলোকে সময়সীমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সেদিনই দুপুরে বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান,জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরা আলোচনা করে একমত হয়ে তাদের মতামত সরকারকে জানায়, সেজন্য সাত দিনের সময় দিচ্ছে সরকার।
জানানো হয়, দলগুলোর মতবিরোধ দূর করতে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে না। এছাড়া সাতদিনের মধ্যে দলগুলো একমত হয়ে কোনো নির্দেশনা দিতে না পারলে তখন সরকার সিদ্ধান্ত দেবে।
সেদিন বিএনপিও তাদের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা করে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর বিএনপি বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের দলীয় মনোনয়নের তালিকা ঘোষণা করে।
মূলত এরপর দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে বিএনপির প্রার্থী তালিকা ও নির্বাচনের প্রসঙ্গ।
অন্য দলগুলো কতটা নির্বাচনমুখী
জুলাই গণ-অভ্যত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী এখন তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জামায়াত বলা যায় এক বছর আগেই জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের জন্য দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। দলটি আঞ্চলিকভাবে সমাবেশ করে প্রার্থীদের ঘোষণাও অনেক আগে দিয়েছে এবং তারা গণসংযোগসহ নির্বাচনী তৎপরতাও চালাচ্ছেন।
এখন বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর জামায়াতের প্রার্থীদের ভোটের তৎপরতা বেড়েছে বলেই দলটির একাধিক নেতা বলেছেন।
এছাড়াও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, তারা এখন ওই প্রার্থীদের তালিকাই দলের কেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন।
জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিও ঘোষণা করেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই ৩০০ আসনের জন্য তারা তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করবে।
বিএনপির মিত্রদের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলন ৯১টি আসনে তাদের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। বর্তমানে সক্রিয় অন্য দলগুলোও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তাদের তৎপরতার কথা বলছে।
ফলে সব দলের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে এখন বাড়তি তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে।
সরকারের সময়সীমায় বিএনপি কি সাড়া দেবে?
বিএনপি নেতৃত্ব এখন দলীয় প্রার্থী তালিকা নিয়ে প্রতিক্রিয়া সামলাতে ব্যস্ত। সরকার যে সময়সীমা দিয়ে দলগুলোকে সংস্কার বাস্তবায়নে একমত হতে বলেছে, সেটাকে দলটি এখন গুরুত্ব দিচ্ছে না, এমন ধারণাই পাওয়া যাচ্ছে।
বেশিরভাগ আসনেই দলটির প্রার্থী হতে আগ্রহী নেতার সংখ্যা একাধিক বা তার চেয়েও বেশি। ফলে দলের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার পর অনেক আসনে বাদ পড়াদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটছে।
বিএনপি তাদের ভোট যাত্রার শুরুতেই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া, দলীয় কোন্দল থামানোর দিকে নজর দিয়েছে।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কিছুতে গুরুত্ব দিচ্ছি না”।
“এ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা কোনো আলোচনা করছি না। তারা (সরকার) যা করার করবে, সে ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ নেই,” বলছেন বিএনপি মহাসচিব।
সংস্কারের সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করতে বড় দল হিসেবে বিএনপি অন্য দলগুলোকে নিয়ে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেবে না। অন্য কোনো দল আলোচনার উদ্যোগ নিলেও তা তেমন গুরুত্ব পাবে না বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করছেন।
কয়েকটি দলের উদ্যোগ
বিএনপির মিত্র জোট গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল, এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ-এই নয়টি দলের নেতারা গত বুধবার নিজেরা আলোচনা করেছেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, আলোচনার মাধ্যমে দলগুলোর মতপার্থক্য কমিয়ে এনে একটা ন্যূনতম জায়গায় ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে তারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
তারা বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনার চেষ্টা করবেন।
তবে এই নয়টি দলের নেতাদের বৈঠকেও মূল বিষয়গুলোতে তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোন বিষয়ে গণভোট হবে, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত গণভোটের ক্ষেত্রে রাখা হবে কিনা-এ নিয়ে নয় দলের নেতাদেরও মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
তবে সরকারের দেওয়া সময়সীমা নিয়ে নয় দলের নেতারা আলোচনা করেছেন। একাধিক সূত্র বলছে, সরকার দলগুলোকে নিজেদের আলোচনা করে একমত হওয়ার জন্য যে সময় দিয়েছেন, এতে জামায়াতকেই কিছুটা বাড়তি সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কারণ জামায়াতও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা আগে বলেছে।
তবে সরকারের সাতদিনের সময়ের চার দিন পার হয়ে গেছে। বাকি সময়ের মধ্যে এই নয় দলের উদ্যোগ কোনো ফল হবে, এমনটা মনে করছেন না দলগুলোর নেতাদের কেউ কেউ।
পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে?
সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি যখন অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ উদ্যোগ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন জামায়াত অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে সময় দেওয়ার বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবেই বর্ণনা করছে।
দলটির সেক্রেটারী জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসিকে বলেন, সরকার সময়সীমা দিয়ে সংস্কারের সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে দলগুলোর বিরোধ দূর করতে সুযোগ দিয়েছে।
জামায়াত আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের অপেক্ষায় থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে নয়টি দল যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কতটা সফল হবে-এনিয়ে ওই দলগুলোরই নেতাদের কারও কারও সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবারই জামায়াতসহ আটটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে, এই নভেম্বরেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে এবং ১১ই নভেম্বরের আগে দাবি মানা না হলে “ওই দিন ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে” বলে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
সময়সীমার মধ্যে দলগুলো একমত না হলে সরকার সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলেছে। বড় দলগুলোর মতপার্থক্যের বিষয়গুলোতে সরকার কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারের সময় দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। দলগুলো মনে করছে, সংস্কার বাস্তবায়ন প্রশ্নে এই সংকটের দায় সরকারের।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসিকে বলেন, সরকার তাদের দায় দলগুলোর উপর চাপাচ্ছে- সেটি সংকট বাড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা





