বালু লুটের শঙ্কায় ইজারাবিহীন ধোপাজান ড্রেজারসহ নৌকা আটক

সুনামগঞ্জ সদর-বিশ্বম্ভরপুর ইজারাবিহীন বৃহৎ বালু মহাল ধোপাজান থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বড় দুটি বাল্কহেডে বালু উত্তোলনের সময় সোমবার সন্ধ্যায় মেশিনসহ বাল্কহেড আটক করেছে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্রশাসন।
বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও মেরিনা দেবনাথ জানান, মহালে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলনকারীরা দাবি করছিল, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাটি দেওয়ার জন্য নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রাজধানী ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লিমপেড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর হয়ে তারা এখানে বালু তুলতে এসেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদেরকে জানিয়ে দেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয় অবগত নন। তাঁদের (ইউএনওর) কাছেও এই সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র নেই। সুতরাং এখানে ড্রেজার লাগিয়ে বালু তোলা যাবে না।
আরও পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় মদপানে ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে আরও ১
সম্প্রতি, ধোপাজান বালু মহালে বালু লুট হতে পারে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসনের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়। এর আগেও গত পাঁচ আগস্টের পর এই মহাল থেকে ২০০ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছিল। এ কারণে একজন পুলিশ সুপারকেও এই জেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
সম্প্রতি নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের সচিব বরাবরে পাঠানো চিঠিতে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক লিখেন— সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধোপাজান নদীর অক্ষয়নগর, উত্তর রামপুর ও রতারগাঁও মৌজা হতে ১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ১২৯ ঘনফুট বালু/মাটি উত্তোলনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লিমপেড ইঞ্জিনিয়ারিং’-কে অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ওই চিঠিতে আইনের ব্যত্যয়ের কথা জানিয়ে বলেন, এভাবে মাটি উত্তোলন করতে হলে জেলা বালু মহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মতি প্রয়োজন। তিনি এই অনুমোদন বিধিবহির্ভূত বলেও উল্লেখ করেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ধোপাজান বালু মিশ্রিত বালু-পাথর মহাল। এই মহালের মালিকানা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের, এখানে মাটি বা ভিট বালু নেই। এই মহাল বালু মিশ্রিত পাথর মহাল। এখানে ভিট বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হলে সিলিকা বালু তুলে নেওয়া হবে। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। চিঠির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পাঠানো হয়। এই বিষয়টি রোববার জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায়ও ব্যাপক আলোচনা হয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে উৎপাদনশীল করতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে: ড. মঈন খান
সোমবার ‘লিমপেড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর হয়ে ওখানে বালু তুলতে গেলে এলাকাবাসী বাধা দেন। তারা বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোন দেন। পরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা দেবনাথ ঘটনাস্থলে গিয়ে ড্রেজার মেশিন ও বাল্কহেড জব্দ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই দুটি বাল্কহেড বালু বোঝাই করে ভাটির দিকে যেতে দেখেছেন তারা। গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর ইজারাবিহীন এই বালু মহালে প্রতিদিন হাজারো ছোট-বড় নৌকা প্রবেশ করে কোটি কোটি টাকার বালু লুট করা নেয়। একাধিক গণমাধ্যমে শত কোটি টাকার বালু লুটপাটের চিত্র ওঠে আসলে, অক্টোবর মাসে জেলা প্রশাসকের ফেসবুক পেজসহ নানাভাবে নদীতে বালু উত্তোলনের নিষেধাজ্ঞা প্রচার করা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় নদীর প্রবেশমুখে বাঁশের আড় দেওয়া হয়। এতেও রক্ষা হয়নি। তখনকার পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায়ও আস্কারা পায় লুটেরাচক্র। প্রশাসনের দেওয়া বাঁশের আড় উপড়ে ফেলেও বালু-পাথর আনা-নেওয়া করেছে বালুখেকোরা। প্রশাসনের আড় দেওয়ার পরেও দিনে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়শ’ বারকী নৌকা-বাল্কহেড বালু-পাথর উত্তোলন করে বহাল তবিয়তে বের হয়েছে। শত শত বোমা মেশিনও ওই সময় দিনে-রাতে চালু ছিল। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা, বিআইডব্লিউটিএ, পৌরসভা, গৌরারং ও সুরমা ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন নামে ওই সময়ে টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজিও হয়েছে।
জেলার বড় পাথর মিশ্রিত বালু মহাল ধোপাজান-চলতি নদী। গত প্রায় সাত বছর হয় এই মহালটি ইজারাবিহীন। বড় এই মহালটি একেক সময় একেক পন্থায় লুটপাট হয়। কোনো সময় জব্দ বালু-পাথর নিলাম নিয়ে এই বালু-পাথর বহনের বৈধতা দেখিয়ে লাখ লাখ ঘনফুট বালু-পাথর উত্তোলন করা হয়। কখনো ড্রেজার মেশিন দিয়ে, কিংবা হাতের যন্ত্র দিয়ে শত শত নৌকায় বালু-পাথর উত্তোলন করে এই লুটপাট চলে। গত সরকারের সময়ে (প্রায় ছয় বছর) এভাবে লুট হয়েছে।
রোববার জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে এই প্রসঙ্গ ওঠে আসে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও সভায় উপস্থিত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামসহ আইনজীবী নেতারাও সরকারি সম্পদ রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান।
সোমবার ধোপাজান-চলতি নদীর মনিপুর হাটির উজানের অংশ (বোমার ঢালার বাঁধের পাশ থেকে) থেকে বালু তোলার সময় ড্রেজার মেশিন ও দুটি বাল্কহেড জব্দ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা দেবনাথ। এ সময় ‘লিমপেড ইঞ্জিনিয়ারিং’-কে দেওয়া নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কাগজপত্র দেখানোর চেষ্টা করেন উত্তোলনকারীরা।
উত্তোলনকারীদের পক্ষে স্থানীয় কয়েকজনকে কথা বলতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন চলতি নদীর পাড়ের বাসিন্দারা। নদীর পাড়ের লোকজন জানান, যারা উত্তোলনকারীদের পক্ষে কথা বলেছেন তারা আগে আওয়ামী লীগের মিছিলে যেতেন, এখন যান বিএনপির মিছিলে। সরকারি সম্পদ লুটের পাশাপাশি পাড় কেটে তাদেরকেও বিপন্ন করতে চায় এরা।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য অ্যাড. শেরেনুর আলী বলেন, ধোপাজান-চলতি নদীর মালিকানা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বালু মহাল লুটের পরিকল্পনা হচ্ছে। রবিবার আইন-শৃঙ্খলা সভায় এটা আলোচনা হয়েছে। সোমবার ওখানে যারা ড্রেজার মেশিন নিয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো পর্যায়ের দায়িত্বশীল কারও সম্পর্ক নেই। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি আমাদেরও।
বিআইডব্লিউটিএর সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক শরিফ ইসলাম বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছয় লেন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের চিঠির প্রেক্ষিতে ধোপাজানের ভিট বালু উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, কে কী বললো, আমরা জানি না, বিআইডব্লিউটিএ আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অনুমোদন দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ আহাদ উল্লাহ বলেন, বিআইডব্লিউটিএ দায় এড়ানোর জন্য সড়ক বিভাগের চিঠির কথা বলছেন। সড়ক বিভাগ ভিট বালু চাইলে পাহাড় কেটে দিতে হবে, এমন যুক্তি দাঁড় করানো ঠিক নয়।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা দেবনাথ বলেন, ইজারাবিহীন এই বালু মহালে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে সোমবার সন্ধ্যায় দুটি নৌকা ও বাল্কহেড জব্দ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী এটা করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে, তারা ওখান থেকে বালু তুলবেন। আমরা বিষয়টি জানিয়ে অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দু’এক দিনের মধ্যেই চিঠি পাঠাবো। সোমবার ওখানে লিমপেড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর হয়ে বালু তুলতে গেলে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে বাল্কহেড ও বোমা মেশিন জব্দ করেছি।
প্রসঙ্গত, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার করা মামলায় ২০১৮ সাল থেকে চলতি নদীর ধোপাজান বালু মহাল ইজারা হয়নি।