ভিট মাটির অনুমতি নিয়ে তোলা হচ্ছে সিলিকা বালু

পাথর মিশ্রিত ধোপাজান নদীতে দুই সপ্তাহে শতকোটি টাকার বালু লুট ২০টি নৌকা জব্দ

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৯:১৫ অপরাহ্ন, ২৭ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১২:৫১ পূর্বাহ্ন, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের সদর-বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ইজারাবিহীন ধোপাজান চলতি নদীতে ড্রেজার-বোমা মেশিনের মাধ্যমে অবৈধ বালু উত্তোলন চলছেই। উচ্চ আদালত নদীর প্রকৃতি ও নৌ-শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার জন্য বালু উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন।

তবে লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন রাতের আধারে ড্রেজার-বোমা মেশিন ব্যবহার করে চলতি নদী থেকে ৪ টাকা ঘনফুট মূল্যের ভিটমাটির পরিবর্তে ৮০ টাকা ঘনফুট মূল্যের সিলিকা বালু উত্তোলন করছে। রবিবার (২৬ অক্টোবর) সদর মডেল থানা ও টুকের বাজার নৌ-পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২০টি নৌকা জব্দ করেছে।

আরও পড়ুন: নরসিংদীতে যুবদলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য র‌্যালি

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় (বিআইডব্লিউটিএ) এক বছরের জন্য এক কোটি ২১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে। তবে সরকার মাত্র এক কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। ভিট মাটি উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে সিলিকা বালু উত্তোলনের ফলে শত কোটি টাকার লুট হচ্ছে, যা খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েও কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নির্বাক।

আরও পড়ুন: সাগর থেকে চার বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি

মেঘালয় সীমান্ত থেকে নেমে আসা ধোপাজান নদীর বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বালু-পাথর খেকো সিন্ডিকেট চক্র পরিবেশ বিধ্বংসী ড্রেজার এবং বোমা মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করছে। ২০১৮ সালে স্থানীয় শ্রমিক ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের দাবিতে আদালতের নির্দেশে উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে পুনরায় বালু উত্তোলন শুরু হয়।

স্থানীয়রা বলেন, “উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিন্ডিকেট প্রতিনিয়ত ড্রেজার ও বোমা মেশিন ব্যবহার করছে। নদীর পাড়ের ঘরবাড়ি ও ফসল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পরিবেশপন্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “যদি ভিটমাটির লীজ বাতিল না করা হয়, নদী তীরবর্তী শতাধিক ঘরবাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিলিন হয়ে যাবে।” এছাড়া, সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় ভিটমাটির নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

হাজী সাজুল মিয়া বলেন, “ফেইক আইডি ব্যবহার করে কু-চক্র আমাদের সম্মানহানি ও ব্যবসায় ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তবে ভিটমাটির নামে সিলিকা বালু উত্তোলন প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”

সরেজমিনে রাত ১০টার পর চলতি নদীর কাইয়েরগাওস্থ এলাকায় একের পর এক বাল্কহেড লোড হচ্ছে। বিকট শব্দে চলছে দুটি বোমা মেশিন ও একটি ড্রেজার মেশিন। ভিটমাটি উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় দানার উন্নতমানের সিলিকা বালু। এগুলো ভিটমাটি নয় তা স্বীকারও করেছেন ড্রেজার শ্রমিকরা।

লিমপিডের টোকেনের দায়িত্বে থাকা এরশাদ মিয়া বলেন, “আমাদের বালু এবং মাটি দুটি উত্তোলনের অনুমতি আছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ থেকে। ড্রেজার চালালে মাটির সাথে বালু আসবেই। দুইটা মিলে ভিট বালু হয়ে যায়।”

সচেতন মহল জানিয়েছে, দিনে প্রকল্পের নামে বালু উত্তোলন হলেও শর্ত ভেঙে রাতের আঁধারেও বালু বিক্রি হচ্ছে। এতে নির্দিষ্ট পরিমানের বাইরে, কয়েক গুণ বেশি বালু লুট হওয়ার শঙ্কা পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের।

মাটির সাথে বালু উত্তোলনের কথা শ্রমিক ও লিমপিডের লোকজন স্বীকার করলেও, বালু উত্তোলনের অনুমতি প্রদানকারী বিআইডব্লিউটিএর সিলেট আঞ্চলিক দপ্তরের উপপরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম তা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “খনিজ সম্পদ বিভাগের গেজেটভুক্ত জায়গার বাইরে থেকে শুধু ভিট মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। আমি নিয়মিত পরিদর্শন করছি। আপনি যদি সরেজমিনে গিয়ে ব্যত্যয় পান, রিপোর্ট করুন।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, “বিআইডব্লিউটিএর এই সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও প্রকৃতির বিরোধী। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা না বলে একটি সরকারি সংস্থা কিভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিল, তা বিস্ময়কর। আমরা জানার পরপরই চিঠি দিয়ে জানিয়েছি যে এখান থেকে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই।”

সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন সংগঠনের সভাপতি এ কে এম আবু নাছার জানিয়েছেন, “ধোপাজান চলতি নদীতে উজান থেকে পাহাড়ী ঢলে নেমে আসা পাথর-বালি হাওরাঞ্চলের দরিদ্র বারকি শ্রমিকরা সনাতন পদ্ধতিতে হাতের সাহায্যে বালতি ও বেলচা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। তবে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ভিটমাটির ইজারাদার মহালগুলোতে ড্রেজার-বোমা মেশিন ব্যবহার করে পাথর-বালি উত্তোলনের ফলে পাথর বালিখেকো সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, “মহালগুলোতে পাথর-বালিতে পরিপূর্ণ থাকলেও ড্রেজার-বোমা ব্যবহারের ফলে ধোপাজান মহালের মূল জায়গা শূন্য হয়ে গেছে। এতে সিন্ডিকেটের লুণ্ঠন ও রাস্তা, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০০৯ সালে যাদুকাটা নদীতে ড্রেজার-বোমা বন্ধে হাইকোর্টে মামলা এবং ধোপাজান নদীতে ৭৪৩১/১৩ একক রিট পিটিশন দায়ের করে। উচ্চ আদালত দুটি নদীতে ড্রেজার-বোমা মেশিন বন্ধের নির্দেশ দেন। ২০১৮ সালে মহালটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, “ধোপাজান খনিজ বিভাগের মালিকানাধীন সম্পদ। আমরা যখন জানতে পারি চলতি নদী থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তখনই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। বালু উত্তোলন করলে নৌকাও জব্দ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বিষয়টি জানে।”