আঞ্চলিক ভারসাম্য ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন

Sanchoy Biswas
মো. শওকতুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১০:৫১ অপরাহ্ন, ২০ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১০:৫১ অপরাহ্ন, ২০ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সূচনা

১। বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আঞ্চলিক শক্তির পুনর্বিন্যাস এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের আবর্তে প্রতিটি দেশ নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সক্ষমতার বিবেচনায় আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করে প্রস্তুত করছে। বিরাজমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বর্তমান আন্তজার্তিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দীর্ঘ ৫৩ বছরের পথচলায় অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ এক পরিনত, পেশাদার ও আত্মবিশ্বাসী বাহিনী হিসেবে জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক, অভিযোজনীয় ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন গভীর ভাবে অনুভূত হচ্ছে।

আরও পড়ুন: দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, ‘ত্যাগ, নির্যাতন ও আপোষহীনতার অনন্য প্রতীক’

২। বিশ্ব জুড়ে যে কোন অঞ্চলের আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিবেচনায় আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে কোন দেশের ভূমিকা অনুধাবনের কিছু পরিমাপক রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সকল পরিমাপকের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিস্তার, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মতো ক্ষেত্র সমূহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহুমাত্রিক অবদান রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে ক্রমবর্ধমান সীমান্ত সংঘাত, সন্ত্রাসবাদী হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিবেচনায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক সংবেদনশীল বিষয়। এ প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় আঞ্চলিক কূটনীতি ও অর্থনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টিও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত জরুরী। আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য তার সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন একটি অন্যতম নিয়ামক হতে পারে।

আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন

আরও পড়ুন: বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে বন্দর চুক্তি: জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রয়োজন দূরদর্শী বাস্তবতা

৩। ১৯৪৭ সালের বিভাজনের পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় এ অঞ্চলের রাষ্ট্র সমূহের সামরিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। সামরিক সক্ষমতা এই আঞ্চলের কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে যেমন প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষায়ও একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিন্যাস দ্বীমেরু বা একমেরু কাঠামো ভেঙ্গে বহুমুখী রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিন্যাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তিত বিশ্বে কোন রাষ্ট্র অপর কোন রাষ্ট্রের স্থায়ী শত্রু কিংবা বন্ধু নয়। রাষ্ট্রসমূহ আজ তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছে মূলত রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভিত্তিতে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিদ্বন্দী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা একই সাথে চলছে। বাংলাদেশকেও ঘিরে রয়েছে একাধিক ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটও এর বাইরে নয়। এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ আঞ্চলিক কৌশলগত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশকেও ঘিরে রয়েছে একাধিক ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ যেমন Act East নীতি, Belt and Road Initiative, রোহিঙ্গা সংকট এবং ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, নেপালের গণঅভ্যূত্থান এর ন্যায় আরও বিভিন্ন বিষয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তান পরিস্থিতি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সীমান্তে অনিশ্চয়তা এবং সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের প্রসার এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে। বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের সামরিক উপস্থিতি ও কৌশলগত বিন্যাস ক্রমেই দৃশ্যমান। এসব স্পর্শকাতর বিষয় মোকাবেলায় একটি আধুনিক ও সক্ষম সেনাবাহিনীর উপস্থিতি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার, সামুদ্রিক অর্থনীতি সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সামরিক উপস্থিতি ও কৌশলগত বিন্যাস ক্রমেই দৃশ্যমান।

প্রযুক্তি ও সামরিক উৎপাদন সক্ষমতার অগ্রগতির মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা

৪. দক্ষিণ এশিয়া ভূ-রাজনৈতিকভাবে অতি সংবেদনশীল একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলের সামরিক শক্তিগুলোর সক্ষমতা ক্রমবর্ধমান। এই অঞ্চল তথা বিশ্বের উন্নত সেনাবাহিনী সমূহ ইতিমধ্যেই কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা (Al), উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামাদি ও সাইবার প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় অভূত পূর্ব অগ্রগতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এই অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে পরিমান গত ও গুনগত উৎকর্ষতার ভারসাম্য বজায় রেখে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা ও নিজস্ব উৎপাদান সক্ষমতা অর্জনে কাজ করছে। নতুন প্রজম্মের সাঁজোয়া যান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পদাতিক সক্ষমতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অবস্থান আরো দৃঢ় করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই কৌশলগত গুরুত্ব বহন করবে। আধুনিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক উৎপাদন শিল্প দেশীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করবে। এতে একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং স্থানীয় শিল্প খাত শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয় অর্জন সম্ভব হবে। দেশের শিল্প-অবকাঠামো প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নত কারিগরি দক্ষতা সৃষ্টির ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। শক্তিশালী সামরিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি বাড়িয়ে তুলবে। এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষায় নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা হিসেবে কাজ করবে। প্রযুক্তি হস্তান্তর ও গবেষণামূলক সহযোগিতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় নিরাপত্তা প্রস্তুতি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। সার্বিক ভাবে, সামরিক উৎকর্ষতা সাধনে অপরিহার্য সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত ও সাইবার প্রতিরক্ষায় উৎকর্ষতা, আন্তর্জাতিক মানের পেশাগত প্রশিক্ষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সামরিক উৎপাদনে স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে আরোও দৃঢ় করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক অবদান

৫। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি শান্তি রক্ষীদের পেশাদারিত্ব বরাবরই আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রেক্ষাপটে এই অবদান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখছে। শান্তি রক্ষায় ভূমিকা আঞ্চলিক আস্থা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ায়। এটি সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও নজরকাড়া। মায়ানমার, নেপাল ও তুরস্কে মানবিক সহায়তা প্রদান এর দৃষ্টান্ত। এসব কার্যক্রম বাংলাদেশকে দায়িত্বশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক আস্থা আরও মজবুত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে।

৬। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলে এই দক্ষতা যথার্থ স্বীকৃতিও পাচ্ছে। দক্ষ শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে সামরিক স্থিতিশীলতার প্রতীক করে তুলছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা কেবল সামরিক শক্তি নয়, বরং কূটনৈতিক আস্থা, মানবিকতা ও সহযোগিতার উপরও নির্ভরশীল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক অবদান এই সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্যে বাংলাদেশ এখন এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার। যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ধরে রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত সক্ষমতা আরও বাড়ানো জরুরী। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই উন্নয়ন জাতীয় স্বার্থ ও কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।

আঞ্চলিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি

৭। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস কিংবা ভূমিধ্বসের মতো বিপর্যয়ের পর সবচেয়ে দ্রুত, সুশৃঙ্খল ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রশিক্ষিত জনবল, দ্রুত মোতায়েনের ক্ষমতা এবং আধুনিক সরঞ্জামের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন কার্যক্রমে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। এই সক্ষমতা জাতীয় পর্যায়ে শুধু জীবন ও সম্পদ রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত মানবিক সঙ্কট প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থী প্রবাহ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ এ ধরনের সংকট নিয়ন্ত্রণে রেখে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। ফলে দেশের নিরাপত্তার পাশাপাশি এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্যও আস্থা ও নিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর এই দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতা কেবল সামরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ নয় বরং মানবিক সহমর্মিতা ও কৌশলগত দায়বদ্ধতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন এক আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যে শক্তি দূর্যোগ পরবর্তী অস্থিতিশীলতা রোধ করে নিরাপত্তা, সহযোগিতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাস্তব ও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

৮। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ সক্ষমতা বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নেপাল, মিয়ানমার কিংবা তুরস্কের মতো দেশে ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগ পরবর্তী মানবিক সহায়তায় সেনাবাহিনীর অবদান কেবল মানবিক দায়িত্বই নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের এক কার্যকর হাতিয়ার। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে একটি দায়িত্বশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক আস্থাকে শক্তিশালী করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে দুর্যোগের ঘনঘটাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়বে। সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অধিকতর আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিনির্ভর সরঞ্জামে সুসজ্জিত করা হলে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বে বাংলাদেশ আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। এর ফলে বাংলাদেশ কেবল জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নয়, বরং আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক আস্থা বৃদ্ধিতেও এক নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশে সমর্থ হবে। মানবিক সহায়তার এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশকে শুধু একটি আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক সহযোগী শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করছে, যা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিক হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবেলায় এই সক্ষমতা আরও শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য এক অপরিহার্য আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে নিজেকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।

উপসংহার

৯। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং মানবিক সহায়তা প্রদানে যে ভূমিকা রেখে আসছে, তা আজ বিশ্বদরবারে দেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিবেশ, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একটি আধুনিক, দক্ষ ও অভিযোজনযোগ্য সেনাবাহিনী কেবল জাতীয় প্রতিরক্ষার শক্তি নয়, বরং এটি কূটনৈতিক আস্থা বৃদ্ধির এক নির্ভরযোগ্য উপাদান। উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, সাইবার প্রতিরক্ষা, নিজস্ব সামরিক উৎপাদনশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোয় আরও প্রভাবশালী করে তুলবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও কৌশলগত দক্ষতার সম্বন্বয়ে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। এমন একটি সেনাবাহিনী শুধু ভৌগলিক সীমারেখাই সুরক্ষিত করবে না বরং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি আত্মবিশ্বাসী, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে অনন্য ভরসা হয়ে দাড়াবে।

১০। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এক কৌশলগত সম্পদ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, সীমান্তবর্তী অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ সামাল দিতে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব আস্থা তৈরি করছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং গবেষণাভিত্তিক সামরিক উৎপাদনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সমৃদ্ধ করা হলে তা কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তাই নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলবে। একটি শক্তিশালী ও আধুনিক সেনাবাহিনী জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক প্রভাব উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ, স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ করে তুলবে। এই সামরিক সক্ষমতা কেবল বর্তমান প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য এক স্থায়ী শক্তি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। অতএব, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক শান্তি প্রচেষ্ঠা এবং জাতীয় অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে সেনাবাহিনীর অবদান এক অনন্য অনিবার্যতা হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে

লেখক: লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মো. শওকতুল ইসলাম