মামলার নিষ্পত্তিতে আইন মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির অভিযোগ
আটকে আছে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানীতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ও সিআইডিতে তদন্তাধীন থাকা অর্থপাচারের মামলাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে করা মালয়েশিয়াতে অভিবাসন সংক্রান্ত মামলা গুলো নিয়ে মালয়েশিয়া সরকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কেননা এইটি মালয়েশিয়ার সরকারের ডিজিটাল অভিবাসন সিস্টেম কে প্রস্নবিদ্ধ করছে যা কিনা অন্য ১৪টি দেশের শ্রমিকের জন্য ট্রান্সপারেন্ট মাইগ্রেশন নিশ্চিত করছে। টিআইপি র্যাংকিং নিম্নমুখী হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাসহ এমনকি আইএমেফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থায় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টি হতে পারে যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। আইন উপদেষ্টা এই বিষয়টিতে আশানরূপ গুরুত্ব না দিলেও বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়া বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত ২৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টোকে ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ ও ‘হয়রানীমূলক’-এ করা মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। পরে সরকারের পক্ষে মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়া সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওইসব চিঠির আলোকে ইতোমধ্যে পল্টন থানায় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেনের করা মানবপাচারের মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে সিআইডি। আদালত ইতোমধ্যে সেটা গ্রহণ করেছে। কিন্তু পল্টন থানায় থাকা মামলার অপর অংশটি (অর্থপাচার) তদন্তাধীন রয়েছে গেছে। এছাড়া সরকারী সংস্থা হিসেবে দুদক বেশ কয়েকটি মামলা করেছে এবং কিছু অনুসন্ধান চলমান আছে। সেগুলো এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার হয়নি। জনশক্তি রপ্তানী সংশ্লিষ্টরা বলছেন মামলা নিষ্পত্তি না করায় প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়ার পরেও জনশক্তি রপ্তানিতে ইতিবাচক ফল আসেনি। কারন এসব মামলার কারনে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ার মানব পাচার সুচক (টিআইপি) তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
আরও পড়ুন: সেনাবাহিনী প্রধানের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই: আইএসপিআর
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় গত ২৬ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে মালয়েশিয়ায় ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত উত্থাপিত অভিযোগ গুলো তারা পর্যালোচনা করেছে। সেখানকার ফরেন ওয়ার্কার সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস)কে তারা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং ডিজিটালাইজড নিয়োগ কাঠামো হিসেবে বলেছে। তারা চিঠিতে আরও বলেছে, ‘সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় কর্মীদের অভিবাসন সম্পর্কিত সমস্ত বিচারাধীন মামলা ও অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়েছে। মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও অপ্রমাণিত হওয়ায় সেগুলো প্রত্যাহার করা, অনুসন্ধান বা তদন্ত থেকে বাদ দেওয়ার উপায় খোঁজার অনুরোধ করে। মালয়েশিয়া চিঠিতে আরও বলেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলার রেকর্ড হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সহায়ক প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি। তাছাড়া ইতোপূর্বে খারিজ হওয়া মামলাগুলি পুনরুজ্জীবিত বন্ধের বিষয়ে তারা তাগিদ দেয়।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এটা মূলত উভয় সরকারের মধ্যামে পরিচালিত আনুষ্ঠানিক নিয়োগ চ্যানেলের মাধ্যমে হয়েছে। এসব শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে মানব পাচারের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চিঠিতে মালয়েশিয়া সরকার স্বচ্ছ এবং নীতিগত নিয়োগ অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের টিআইপি (মানব পাচার র্যাঙ্কিং) বজায় রাখা এবং উন্নত করার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে। ’
আরও পড়ুন: দুর্নীতির তদন্তে সাবেক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ব্যাংক হিসাব তলব
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার চিঠির পর গত মে মাসে ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়। ওই সভায় দুপক্ষই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। পরে গত আগস্ট মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় করে চিঠির জবাব দেন। ‘চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে উত্থাপিত ‘মানব পাচার’ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ গুলো মূলত: অপ্রমাণিত। এসব অভিযোগ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন করছে। ওই সময়ের মধ্যে উভয় সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী কর্মীকে দু’দেশের সম্মতিতে নিয়োগ করা হয়েছে। গত মে মাসের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সভায় সমস্ত বিচারাধীন অভিযোগ বা মামলা পর্যালোচনা করা এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী সরবরাহের ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ প্রত্যাহার করা এবং পারস্পরিক আস্থা পুনরুদ্ধার করার কথা বলা হয়। বাংলাদেশ সরকার মনে করে এসব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে মানব পাচার র্যাঙ্কিং (টিআইপি) সংরক্ষণ এবং উন্নত করা সম্ভব হবে।’
জনশক্তি রপ্তানী সংশ্লিষ্টরা জানান, মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার পর ইতোমধ্যে সিআইডিতে তদন্তাধীন থাকা রাজধানীর পল্টন থানায় করা মানবপাচারের মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অর্থপাচারের অভিযোগটি সিআইডিতে তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগে কাজ করা কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মালয়েশিয়া সরকার ইতোমধ্যে মামলাগুলো ‘অপ্রমাণিত’ ও ‘হয়রানীমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তাই প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়ার সফরে যাওয়ার আগে মামলাগুলো প্রত্যাহার হওয়া জরুরী। এর আগে ১০ রিক্রুটিং লাইসেন্স যখন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়েছিল তখনও দুদক মামলা করেছিল। কিন্তু সেগুলো পরে প্রমাণ না হওয়ায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে।’
জনশক্তি রপ্তানী সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, মূলত: ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে ব্যবসায়িদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে করা মামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। অথচ কোন ভুক্তভোগী বা পাচারের স্বীকার কোন শ্রমিক মামলা করছে না। দুদেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। সেখানে মানবপাচার বা অর্থপাচারের কোন ঘটনা ঘটেনি। ইতোপূর্বে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা মালয়েশিয়া সরকারকে সকল ধরনের অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত প্রত্যাহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতির চার মাস পেরিয়ে গেলেও মামলাগুলো প্রত্যাহার হয়নি। এখন প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় যদি মামলাগুলো প্রত্যাহার বা ফাইনাল রিপোর্ট সংক্রান্ত নথি মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা যায়; তাহলে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্রুতই বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে অনেক বড় ও রেমিট্যান্স আরোহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বায়রার মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কোন রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করলো, কোন এজেন্সি করলো না সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে কম অভিবাসন ব্যয় বা শুন্য অভিবাসন ব্যায়ে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আমরা চাই আমাদের শ্রমিকরা ভালো থাকুক, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিপাক।