স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ, বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি

Sanchoy Biswas
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ৭:৪৯ অপরাহ্ন, ২৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১১:৩৬ অপরাহ্ন, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত
  • প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছে দেড় কোটি,নারীর চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ
  • বৈশ্বিক মৃত্যুর দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে
  • দেশে ১.১৪ শতাংশ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়
  • দ্রুত স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে

দিনকে দিন প্রাণঘাতি রোগে ‘স্ট্রোক’ প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে মৃত্যুরকুলে ঢলে পড়ছে অর্ধকোটি মানুষ, আর অর্ধকোটি পঙুত্ব বরণ করছেন। এককথায় বলতে গেলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রোকে মৃত্যু ও রোগীর সংখ্যা। রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী। একইসঙ্গে দেশে স্ট্রোক রোগীদের জন্য নেই যথাযথ চিকিৎসাব্যবস্থা। নানা সংকট আর অপ্রতুলতায় ভুগতে হচ্ছে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের। তবে ঘাতক এ ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকতে সচেতনতার বিকল্প নেই। 

মারা যাওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ দেশের  সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার প্রায় ৮০ গুন বেড়ে যাবে। বাংলাদেশেও এ হার কিন্তু কম নয়। দেশে প্রতি এক হাজার জনে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। 

আরও পড়ুন: গ্যালারী হামিদুজ্জামানে চলছে যৌথ প্রদর্শনী ‘ছকের বাইরে জীবন’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকা ছাড়া কোনো জেলাতেই স্ট্রোকের রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এতে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের সিঁড়ি বারান্দায় মানবেতর জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। এতে রোগীদের মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা এও বলছেন, স্ট্রোক মস্তিষ্কের (ব্রেইন) অসুখ। সচেতনতার ঘাটতি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রবণতা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ নানা কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। কোনো কারণে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্তক্ষরণ বা রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে স্ট্রোক হয়। স্ট্রোক থেকে প্যারালাইসিস এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ স্টোকে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সুমন রানা বলেন, আমরা অনেক সময় বলি, শহরের মানুষের বেশি স্ট্রোক হয়, গ্রামে হয় না। কথাটা ঠিক না। অনেক সময় দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ গ্রামের মানুষেরই স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ আর অন্যরা ৩৬ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের ৩২ থেকে ৪৫ বছরের সময়ই ৬৪ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে। কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম এর সঙ্গে। তিনি বলেন, যারা স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৪৮ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপের রোগী। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন ৩৬ শতাংশ রোগী, অতিরিক্ত চর্বি রয়েছে ১৯ শতাংশের, মানসিক চাপের কারণে স্ট্রোক হয় ১৭ শতাংশ রোগীর। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। একইসুরে কথা বলেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এস জহিরুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, স্ট্রোক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোকের রোগীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সময়। যত দ্রুত সম্ভব, স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। তিনি বলেন,স্ট্রোকের কারণে প্যারালিসিসের (পক্ষাঘাত) মতো মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়, কিছু স্ট্রোকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। স্ট্রোক হলে শরীরের যেকোনো একদিকে হাত-পা ও মুখমণ্ডল প্যারালাইজ হয়ে থাকে। ব্রেইনের ভেতর স্ট্রোকটা যদি বাঁ দিকে হয়, তাহলে ডান দিকের হাত-পা এবং ডান দিকে স্ট্রোক হলে বাঁ দিকের হাত-পা প্যারালাইজ হয়ে থাকবে।

দেশে ১.১৪ শতাংশ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়: ‘বাংলাদেশে প্রায় ১.১৪ শতাংশ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ শতাংশে। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো- এখন অল্পবয়সি অর্থাৎ ৪০ বছরের নিচের মানুষও স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন, যার হার প্রায় ০.৪৬ শতাংশ। গতকাল বুধবার ‎বিশ্ব স্ট্রোক দিবস-২০২৫ উদযাপন অনুষ্ঠানে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোমেন খান এ তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্ট্রোকের রোগীরা যদি লক্ষণ প্রকাশের ৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আসতে পারেন, তবে আইভি থ্রম্বোলাইসিসের মাধ্যমে কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ স্ট্রোক এবং স্ট্রোক-পরবর্তী অক্ষমতায় প্রায় ৩৯.৪ শতাংশ মানুষ ভোগে। স্ট্রোকের প্রধান কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন উচ্চ রক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া ও ধূমপানকে। দিবসটি ঘিরে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী এ কর্মসূচিতে স্ট্রোক প্রতিরোধ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দ্রুত চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ‎আলোচনা সভায় বক্তারা স্ট্রোক প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন পরিহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচি স্ট্রোক বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আয়োজকরা আশা প্রকাশ করেন। পরে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে এক বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়, যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অংশ নেন। র্যালিটি ক্যাম্পাস ঘুরে সচেতনতা বার্তা প্রচার করে। ‎‎অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ আক্তার হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাকি মোহাম্মদ জাকিউল আলম। ‎‎এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুরুজ্জামান খসরু, নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজেশ সাহা, ডা. নাজমুল ইসলাম জয় ও ডা. নাজমুল আলম, নিউরোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সিবাত আমিন খলিল এবং সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. আবু ইসহাক।

আরও পড়ুন: টিকাদান সম্প্রসারণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার অনুষ্ঠিত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। বিশ্বে প্রতি চারজনের একজনের মৃত্যু হয় স্ট্রোকে। প্রতি মিনিটে ১০ জন স্ট্রোকের কারণে মারা যান। এমনকি ১০০ জন স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর ৪৮ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। শিশুদের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতি লাখে ২ থেকে ১৩ জন শিশু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে স্ট্রোকের অর্ধেক হয় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে, বাকি অর্ধেক হয় মস্তিষ্কের রক্ত নালি ছিঁড়ে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। বছরে আক্রান্তদের ১০ থেকে ২৫ ভাগ শিশু স্ট্রোকে মারা যায়। ২৫ ভাগ শিশু বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ৬৬ ভাগ শিশুদের হাত পায়ের দুর্বলতা, খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। স্ট্রোকে আক্রান্ত শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। দেশে এই মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ মানুষ স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে সাম্প্রতিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিলেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনে দাঁড়ায়, প্রায় দ্বিগুণ।

নারীর চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ: নারীর চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দুই গুণ বেশি। নারী প্রতি হাজারে প্রায় আটজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর পুরুষ প্রতি হাজার ১৪ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকলেও শিশুরাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি বছর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। ষাটোর্ধ বয়সী স্ট্রোকের রোগী প্রায় সাতগুণ। দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কম বয়সী স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালে ভর্তি স্ট্রোকের রোগীদের ২২ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের কম। ত্রিশের কম বয়সীর সংখ্যাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সীরা স্ট্রোক আক্রান্ত হলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার বা মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রোক প্রতিরোধে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগে স্ট্রোকের রোগী বেশি। এ বিভাগে প্রতি হাজারে ১৪ দশমিক ৭১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। এ হাসপাতালে মাসে ৬০০ জনের বেশি স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে ময়মনসিংহ মেডিকেলের নিউরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দারিদ্র্যের হারও বেশি। এদিকে শিক্ষার হার তুলনামূলক কম। ফলে সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্ট্রোক হওয়ার পর রোগী জানতে পারেন যে আগে থেকেই তিনি ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। এছাড়া ধূমপানও একটি কারণ।