পণ্য খালাসে কিছু কর্মকর্তার খেয়াল খুশি সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত , হুমকির মুখে তৈরি পোশাক শিল্প, , নিত্য পণ্য আমদানিকারকরা

চট্টগ্রাম কাস্টমসে চরম হয়রানি

Any Akter
খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১:৩৪ অপরাহ্ন, ১৮ মে ২০২৪ | আপডেট: ১:৫১ অপরাহ্ন, ১৮ মে ২০২৪
ছবিঃ সংগৃহীত

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিভিন্ন পণ্য খালাসে ব্যাপক বাঁধা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে দেশের ছোট বড় আমদানিকারকরা। এতে রপ্তানি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায়  পাশাপাশি শিল্প  ও নিত্য পণ্য আমদানিকারকরা চরম হয়রানির শিকার হয়েছে। আমদানি রপ্তানিতে অব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতি চরম ক্ষতির শিকার বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন মালামাল আমদানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির অভিযোগ তুলেছে ব্যবসায়ীরা।

যারা হয়রানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

আমদানি কারক সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সরকারি বেসরকারি খাতের আমদানিকৃত মালামাল খালাসে বাঁধা সৃষ্টির মাধ্যমে চরম হয়রানি সৃষ্টি করছে কতিপয় কর্মকর্তা। যেমন গার্মেন্টস শিল্প এবং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত মালামাল, কেমিক্যালসহ অন্যান্য মালামাল খালাস করার জন্য নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করলেও বিভিন্ন কর্মকর্তারা সিস্টেমের অজুহাতে বাঁধাগ্রস্থ করছে। দেশের প্রচলিত কাস্টম বিধি এবং নিকটতম সময়ে আমদানি বা খালাস করা হয়েছে সেরূপ নিয়ম অবজ্ঞা করে মনগড়া চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে কালক্ষেপন করা হচ্ছে। যে কারণে দীর্ঘদিন পোর্ট ডেমারেজসহ অন্যান্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। পূর্বে নির্ধারিত পণ্যের ভ্যালু অনুসরণ না করে বা আমদানি মূল্য নির্ধারণের সঠিক বিধি নিষেধ না মেনেই খেয়াল খুশি মতো মালামাল খালাসে আপত্তি দিয়ে ফাইল আটকে রাখছে। উপেক্ষা করা হচ্ছে পূর্বের পণ্য খালাসের রেফারেন্স। এতে দেশের আমাদানি খাতের রাজস্ব হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও হতাশ হয়ে পড়ছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে গত বুধবার (১৫ মে) কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমানের সঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি এস এম মান্নানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক করেছে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে যারা হয়রানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। প্রতিনিধিদল আমদানি করা ওভেন কাপড়ের চালান ছাড়করণ, রপ্তানি পণ্যের চালান জাহাজীকরণে ওজনজনিত সমস্যা, ডকুমেন্টেশন সমস্যা এবং আমদানি করা পণ্যের চালান খালাসকালে এইচএস কোড–সংক্রান্ত জটিলতাসহ কাস্টমস সম্পর্কিত পরিষেবাগুলোতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।

বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের সার্বিক কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন ও সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য কাস্টমস–সংক্রান্ত পরিষেবাগুলো আরও দ্রুততর এবং সহজ করার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, পোশাকশিল্পের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমে কাস্টমস–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ায় অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় তৈরি পোশাকের ব্যবসায় খারাপ সময় চলছে। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি নেই সেভাবে। তার বিপরীতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ, দ্রুততর ও হয়রানিমুক্ত করা প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য ও শিল্পে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এ খাতে সরকারের নীতি সহায়তা দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বিজিএমইএর প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করে বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, কাস্টমসের হয়রানি এটি কোন নতুন বিষয় নয়। কাস্টমসের সূচনা লগ্ন থেকে হয়রানির বিষয়টি জড়িত। দিন দিন এই হয়রানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েদেছ। নতুন করে যোগ হয়েছে গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত মালামাল আমাদানির ক্ষেত্রে নানা বাঁধা ও হয়রানি। কতিপয় কর্মকর্তারা নানা সিস্টেমের অজুহাতে আমাদানি করা মালামাল খালাসের ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপন করছে। এতে শুধু ব্যবসায়ীরা নন, দেশের অর্থনীতিও বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা চাই আমদানীকারকদের পণ্য দ্রুত সময়ে খালাসের সুযোগ সৃষ্টি হোক। কোন আমদানিকারক বা প্রতিষ্ঠানের কোথাও ত্রুটি থাকলে এ ব্যাপারে জরিমানা বা আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মালামাল খালাসে বাঁধা এবং হয়রানি সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করা কারো কাম্য হতে পারে না।

কাস্টম হাউস, চট্টগ্রামের এডিশনাল কমিশনার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, আমদানি করা মালামালামাল খালাসের ক্ষেত্রে কিছু বিধান রয়েছে। যেমন ঘোষণার সত্যতা যাচাই, পণ্যের পরিমাণ, বিভিন্ন ডকুমেন্টসহ আরও নানা বিষয়। এসব বিষয় যাচাই করাও একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার কোন কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে নতুন কোন কর্মকর্তা এসে সবকিছু বুঝে উঠতেও কিছুটা সময় লেগে যায়। এমন নানা কারণে অনেক সময় কোন কোন ব্যবসায়ীরা সমস্যার সম্মুখিন হতে পারেন। এমন পরিস্থিতির শিকার হলে বিষয়টি উর্ধ্বতনদের নজরে আনা হলে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।

বিভিন্ন সি এন্ড এফ এজেন্ট বিশেষ ভাবে জনাব কাজী ইরাজ ইসতিয়াক, ডেপুটি কমিশনার-এর একাধিকার দাপট নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের কাছে জানা যায় যেকোনো মালামাল খালাসের নিমিত্তে তার নিকট ফাইল প্রস্তুত করে উপস্থাপন করা হলে তিনি তার ব্যাক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে দেশের প্রচলিত কাস্টম বিধি বা নিকটতম সময়ে আমদানিকৃত একই মালামাল খালাস করা হয়েছে সেরূপ মালামালের ক্ষেত্রেও পূর্বের রিফারেন্স না মেনেই তার ব্যাক্তি চিন্তার মাদ্ধমে পণ্য খালাসে বাধা দিচ্ছেন এবং কাল ক্ষেপন করছেন, যার ফলে দীর্ঘদিন পোর্ট ডেমারেজসহ অন্যান্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়াও উনি পূর্বে নির্ধারিত খালাসকৃত পণ্যের ভ্যালু অনুসরণ না করে বা আমদানি মূল্য নির্ধারণের সঠিক বিধি নিষেধ না মেনেই নিজের মতো করে উক্ত মালামাল খালাসে অনাপত্তি দিয়ে ফাইল আটকে রাখছেন এবং আলোচনা করুন নোট দিয়ে তা ফেলে রাখছেন এবং আমদানিকৃত মালামালের  মূল্যমান বা ভ্যালু বৃদ্ধি করার নোট প্রদান করছেন। যা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয় বলে  আমদানিকারকরা মনে করেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা যায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত  কাজী ইরাজ ইসতিয়াক, ডেপুটি কমিশনার-এর  অধীন সকল সরকারী মালামাল খালাসের কাজ, ডিউটি ফ্রি বন্ড-এর মালামাল, সকল প্রজেক্টের মালামাল খালাসের কাজ, বিদ্যুৎ, ওয়াশা, আর্মি, নেভি বিমান বাহিনির মালামাল খালাস এর কাজ, ও কেমিক্যাল মালামাল খালাসের কাজ হয়। ফাইল প্রস্তুত হলেই হয়রানি করছেন। তিনি বিভিন্ন ভাবে যত ফাঁকফোকর বের করে এমনকি ১০ দিন আগে নিজে ফাইল ছেড়ে একই জাতীয় মালামাল আবার খালাসের জন্য নতুন ফাইল গেলে নতুন করে বাধা সৃষ্টি করছেন। অথচ দেখা গেছে  মাত্র ১০ দিন আগেই এই মালামাল খালাসের ফাইল ছেড়েছেন, সে রিফারেন্স উপস্থাপন করলেও তিনি বলবেন আগে আমি ভুল করছি এখন হবে না । মূলত তিনি তার পদাধিকার বলে নিয়মনীতি না মেনে তিনি একাধিকারভাবে বা গায়ের জোরে নানান ভাবে আমদানি কারকদের মালামাল খালাসে হয়রানি করছেন।  

এছাড়াও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে কিছু আমদানিকারক নিরুপায় হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং মালামাল খালাসের জন্য আদালত থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু উক্ত ডেপুটি কমিশনার বিজ্ঞ আদালতের আদেশ নির্দেশও তোয়াক্কা করছেন না এবং প্রকৃত তথ্য জ্ঞান ছাড়াই তিনি নিজের মতো করে কান্ট্রি অব অরিজিন দেখে পণ্যের ব্র্যান্ড আলাদা হওয়া সত্ত্বেও সমজাতীয় পণ্য হিসেবে ব্যাক্তিগত ভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করছেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে কাস্টমসের যত সমস্যা আছে, তার মধ্যে সেবাগ্রহীতারদের হয়রানি বড় একটি বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। সামনের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়গুলো তোলা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গত সোমবার (১৩ মে) সচিবালয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এসব কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, পোশাক শিল্পকে আমরা শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হিসেবে দেখছি না, সমাজ পরিবর্তন ও দারিদ্র্য বিমোচনে এ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ শ্রমিক নারী। নারীরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। কাজেই সেই শিল্পকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।