কৃষি উপকরণের চড়া দরে দিশেহারা কৃষক

দশ বিঘা জমিতে ছিল আশরাফ আলীর চাষাবাদ। তার মধ্যে সাত বিঘা জমি বিলীন হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে। অবশিষ্ট জমি অল্প হলেও চাষাবাদ করে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাঁর দিন। হঠাৎ কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। চাষাবাদ করে আগের মতো আর পুষিয়ে উঠতে পারছেন না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। সার-বীজ ও শ্রমিকের চড়া দরে অনেকের মতো দিশেহারা হয়েছেন তিনি।
আশরাফ আলীর ভাষ্য, জমি চাষ করে সংসার চলে তাদের। আমন মৌসুমে ধানের আবাদ করে সারা বছরের চলার মতো ধান উৎপাদন করেন। কিন্তু কৃষি উপকরণের চড়া দরে তারা দিশেহারা। বর্তমানে বাজারে হাইব্রিড ধান বীজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদের ধানের বীজতলা নেই তারা চড়া দরে রোপা আমনের চারাবীজ ক্রয় করে রোপণ করছেন। বর্তমানে রোপা আমন চারাবীজের মূল্য বেড়েছে। সারের দাম বেশি। বেড়েছে ডিজেলের দামও। চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে চাষাবাদ করে তেমন লাভের দেখা মেলে না। যা আসে তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু কষ্টের কথা ‘না পারছেন সইতে, না পারছেন অন্যের কাছে কইতে’। এ অঞ্চলের অন্য চাষিদের অবস্থাও তাঁর মতো।
আরও পড়ুন: কারো ক্ষমতা নেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর: খোকন
আশরাফ আলীর বাড়ি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের পোল্যাকান্দি নামাপাড়ায়। গ্রামে ঢোকার পথে প্রথমেই মূল সড়কের পাশেই তার বাড়ি। স্ত্রী, ছেলেদের নিয়ে ভিটেপাকা টিনশেড ঘরে বাস করেন আশরাফ আলীর পরিবার। আশরাফ আলীর মতো দেওয়ানগঞ্জের ৫২ হাজার ৮৬১ কৃষক পরিবারের একই দশা। নিত্যপণ্য ও কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
বাহাদুরাবাদ নাজিরপুর গ্রামের চাষি আব্দুর রউফ বলেন, বর্ষার শেষে জমি ভেজা থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। এই সময়টাতে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। আগে রোপা আমন চাষে বিঘাপ্রতি খরচ যেত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর বর্তমানে কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে রোপা আমন চাষে বিঘাপ্রতি ব্যয় হচ্ছে আট থেকে দশ হাজার টাকা। রোপা আমন চাষ করে এখন আর তেমন লাভ দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: বগুড়ায় বিএনপির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন
উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান, আখ, পাট, ভুট্টা ও আখ। এর মধ্যে বেশির ভাগ চাষিদের খাদ্যের যোগান দেয় ধান। চলতি রোপা আমন মৌসুমে ৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪ হাজার ৯৮০ হেক্টর রোপা আমন লাগানো হয়েছে। বাকি জমিতে সেপ্টেম্বরের প্রথম পক্ষের মধ্যে লাগানো শেষ হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৫২ হাজার ৮৬১ কৃষক পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে বড় কৃষক পরিবার ৫০, মাঝারি কৃষক পরিবার ২ হাজার ২২৫ হাজার। ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার ২২ হাজার ৫১১ হাজার। ভূমিহীন কৃষক পরিবার ২ হাজার ৪৮৫ এবং প্রান্তিক কৃষক পরিবার রয়েছে ২৫ হাজার ৫৯০টি।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, গত বছর রোপা আমন মৌসুমে শ্রমিকের মজুরি ছিল প্রতি শ্রমিক ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে এ বছর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে প্রতি শ্রমিকের মজুরি হয়েছে ৭০০ টাকা। বীজ তলায় চারা বীজ উৎপাদনের শুরুর দিকে প্রতি কেজি ধানবীজ প্যাকেটের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৪৪০ টাকা। কিন্তু চলতি বছর তা বিক্রি হয়েছে ৪৭০ থেকে ৫৮০ টাকায়। সেই কারণে প্রতি বিঘা রোপা আমনের ছোট চারাবীজের দাম চলতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর প্রতি বিঘা রোপা আমনের ছোট চারাবীজের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি বছর ৫০০ টাকা বেড়ে তা হয়েছে ২ হাজার টাকা।
সরকার নির্ধারিত সারের মূল্য ইউরিয়া প্রতি বস্তা ১ হাজার ৩৫০, মিউরিয়েট অব পটাশ ১ হাজার, ডিএপি ১ হাজার ৫০ এবং টিএসপি ১ হাজার ৩৫০ টাকা। তার মধ্যে ইউরিয়া সার সরকার নির্ধারিত মূল্যে খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান বাজারে টিএসপি সারের যোগান নেই। কিন্তু মিউরিয়েট অব পটাশ (এমওপি) খুচরা বাজারে ১ হাজার ৩২০ এবং ডিএপি ১ হাজার ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ উপজেলায় ২১ জন বিসিআইসির অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিসিআইসির সার ডিলারগণ সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি করছেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের খুচরা ব্যবসায়ীরা এমওপি ও ডিএপি সারের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে স্থানীয় ভাবে সিন্ডিকেট করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বেশি দরে বিক্রি করছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত সারের বাজার মনিটরিং করছেন।
এ অঞ্চলের চাষিরা জানিয়েছেন, চালসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি পায়নি ধানের বাজার। গত বছর এ মৌসুমে বাজারে প্রতি মণ ধান বেচাকেনা হতো ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। চলতি বছর তা অপরিবর্তিত রয়েছে। এ অঞ্চলে এক বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৫ মণ রোপা আমন ধান ফলে। প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৩০০ টাকায় বেচাকেনা হলে গড় উৎপাদন ১২.৫ মণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২৫০ টাকা। এক বিঘা জমিতে ধান চাষে মোট ব্যয় হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। সে হিসেবে রোপা আমন চাষ করে একজন কৃষক নীট মুনাফা পাচ্ছেন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এর মধ্যে রয়েছে নিজের শ্রমের মজুরি। তাঁরা জানান, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রোপা আমন চাষে এখন আর নেই আগের মতো মুনাফা।
বর্ষা মৌসুম শেষে রোপা আমন চাষ হয় বলে এতে অধিকত্ব বন্যার ঝুঁকি থাকে। বেশিরভাগ সময়ই কৃষকের লাগানো রোপা আমন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে কারণে রোপা আমন চাষ অধিকাংশ ঝুঁকির ফসলের মধ্যে পড়ে। বন্যার কারণে এ ধান চাষে বেশির ভাগ সময় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চার বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষ করেছেন পাথরের চরের আব্দুল জব্বার। তাতে আগে মোট ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এবার তিন বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষ করতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার টাকা। আগের বছর শেষে অবশিষ্ট না থাকলেও খাওয়া-পড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবাদের ধানে সারাবছর সংসার চলেছে। কিন্তু এবার রোপা আমন চাষ করে ব্যয় পুষিয়ে লাভ দেখা কঠিন।
বাঘারচর সরকার পাড়া গ্রামের ধান চাষি মো. রবিউল ইসলামের ভাষ্য, তিন বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষ করেছেন তিনি। তাতে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় হয়েছে। সামনে বন্যার ভয় আছে। এ অঞ্চলের জমি নিচু। অল্প বন্যাতেই পানি ওঠে। একটু বন্যা হলে ধান ক্ষেত বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়। তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত সে ধান ঘরে ওঠাতে পারবেন কিনা। তাঁর মতো অনেকেই এমন শঙ্কা করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. রতন মিয়া বলেন, এ উপজেলায় রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। ইতিমধ্যে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো ক্ষতি না হলে এবং কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেলে কৃষক লাভবান হবেন। কোনো ব্যবসায়ি যেন সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি বা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে সার বিক্রি না করে সে জন্য উপজেলা কৃষি বিভাগ সর্বদা সচেষ্ট রয়েছেন।