প্রত্যাবর্তনের রাজনীতি: তারেক রহমান ও নেতৃত্বের ভাষান্তর
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নতুন নয়। নির্বাসন, কারাবরণ কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর রাজনীতিতে ফিরে আসার নজির এ দেশে বহুবার দেখা গেছে। কিন্তু সব প্রত্যাবর্তন এক রকম প্রভাব ফেলে না। কোনোটি কেবল সংবাদ হয়, কোনোটি আলোচনার জন্ম দেয়, আবার কোনোটি রাজনীতির ভাষা ও আচরণ নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফেরা তেমনই একটি ঘটনা- যার গুরুত্ব কেবল উপস্থিতিতে নয়, বরং সেই উপস্থিতি যেভাবে নির্মিত হয়েছে, তার ভেতরে নিহিত।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়া: দেশ এবং জনগণের নেত্রী
এই প্রত্যাবর্তনের সূচনালগ্নেই উচ্চারিত হয় একটি বাক্য- “I have a plan for the people of my country, for my country” রাজনৈতিক বক্তব্যে এমন বাক্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ভাষা ও সময় নির্বাচন এটিকে আলাদা করে তোলে। ইতিহাসে ফিরে তাকালে মনে পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই বিখ্যাত উক্তি- “I have a dream” কিংয়ের উক্তি ছিল একটি নৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, যেখানে স্বপ্ন ছিল পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। তারেক রহমানের বক্তব্যে স্বপ্নের জায়গায় এসেছে পরিকল্পনা। এই ভাষাগত পরিবর্তন আকস্মিক নয়; এটি রাজনীতির এক ধরনের পরিণত রূপের ইঙ্গিত দেয়- যেখানে কেবল আকাঙ্ক্ষা নয়, বাস্তবায়নের দায়ও সামনে আসে।
এই দায়বদ্ধতার প্রতিফলন দেখা যায় প্রত্যাবর্তনের প্রথম দৃশ্যেই। বিমানবন্দরে নেমে তারেক রহমান সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে নিরাপত্তা ও সম্মান প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি ব্যতিক্রমী আচরণ। দীর্ঘদিন ধরে এখানে রাজনীতি মানেই দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং প্রতিপক্ষকে উপেক্ষা করার সংস্কৃতি। সেই প্রেক্ষাপটে এই সৌজন্যমূলক আচরণ একটি ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষা নির্মাণ করে- যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান দেখানোকে দুর্বলতা নয়, বরং পরিণতিবোধ হিসেবে দেখা হয়।
আরও পড়ুন: নিষিদ্ধ পলিথিনের দাপট, রুখবে কে?
এই রাষ্ট্রবোধের পরই সামনে আসে প্রতীকী আরেকটি দৃশ্য। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে তারেক রহমান জুতা খুলে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন এবং হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করেন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর এটি নিছক আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনীতিতে প্রতীক অনেক সময় বাস্তবতার আগাম সংকেত দেয়। এই আচরণ যেন জানিয়ে দেয়- দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণই এখন রাজনীতির প্রথম ধাপ।
নিরাপত্তা ও ক্ষমতার প্রশ্নে তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত নেন, তা এই ধারাবাহিকতারই অংশ। তার জন্য প্রস্তুত বিশেষ বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার না করে তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে একই বাসে করে সংবর্ধনা স্থলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এটি কোনো তাৎক্ষণিক আবেগী সিদ্ধান্ত নয়। বরং এটি নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণা তুলে ধরে- নেতা আলাদা কোনো সত্তা নন, বরং দলের ভেতরেই অবস্থান করেন। কর্মী ও সমর্থকদের কাছে এই দৃশ্য সমতার একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়, যা বক্তৃতা দিয়ে বোঝানো কঠিন।
এই যাত্রাপথেই তৈরি হয় পুরো প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে আলোচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য। বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর ‘৩০০ ফিট’ এলাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত দীর্ঘ পথজুড়ে তারেক রহমান বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই পথটি বাস্তবেই দীর্ঘ, এবং পুরো সময়জুড়ে তিনি জনতার দিকে মুখ করে থাকেন। হাত নেড়ে, দৃষ্টির মাধ্যমে, তিনি লাখো মানুষের ভালোবাসার জবাব দেন। এটি কোনো এক মুহূর্তের ফ্রেম নয়; এটি সময় ধরে চলা এক ধরনের জনসংযোগ, যেখানে নেতা ও জনতার মধ্যে কোনো কাচের দেয়াল ছিল না।
এই দৃশ্যের মধ্য দিয়েই অনেকের মনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভঙ্গির কথা ফিরে আসে। এটি কোনো স্লোগান বা উত্তরাধিকার দাবি দিয়ে তৈরি হয়নি। বরং জনতার সামনে দাঁড়িয়ে দায় নেওয়ার মানসিকতা থেকেই এই তুলনার জন্ম। রাজনীতিতে উত্তরাধিকার কখনো কখনো বলা নয়, বরং দেখানোর বিষয়- এই দৃশ্য সেটিই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই ধারাবাহিকতার পর আসে একটি ব্যক্তিগত কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বিমানবন্দর থেকে তিনি অসুস্থ মায়ের কাছে না গিয়ে সরাসরি জনসমাবেশে অংশ নেন। আবেগের জায়গা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট করে- এই প্রত্যাবর্তনকে তিনি ব্যক্তিগত উপলক্ষ হিসেবে নয়, বরং জনতার সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখেছেন।
মঞ্চে ওঠার পর তার আচরণ ও বক্তব্য এই বার্তাকে আরও শক্তিশালী করে। তার জন্য নির্ধারিত বিশেষ চেয়ার সরিয়ে তিনি বসেন সাধারণ কাঠের চেয়ারে। এটি ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, বরং ক্ষমতার প্রতি সংযত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। বক্তব্যে তিনি স্মরণ করেন ১৯৭১-এর শহীদদের, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ২০২৫ সালের শহীদ ওসমান হাদিকে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- তিনি কোনো প্রতিহিংসা বা ঘৃণার ভাষা ব্যবহার করেননি।
বরং পুরো বক্তব্যজুড়ে শান্তি, ঐক্য এবং সম্মিলিতভাবে দেশ গড়ার কথা বারবার উঠে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ভাষা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত ও বিভাজনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত একটি সমাজে এমন সংযত ভাষা সহজে উপেক্ষা করা যায় না। এটি কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, তবে রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
এই প্রত্যাবর্তনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিশাল জনসমাগম সত্ত্বেও পুরো আয়োজনটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়া। কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা, সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। এটি যেমন সাধারণ মানুষের সচেতনতার পরিচয় দেয়, তেমনি বিএনপির নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলারও প্রমাণ। রাজনীতিতে শৃঙ্খলা নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়, কিন্তু এর উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
সব মিলিয়ে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন কেবল একজন নেতার দেশে ফেরা নয়। এটি নেতৃত্বের ভাষা, আচরণ ও অগ্রাধিকার নিয়ে একটি নতুন আলাপ শুরু করেছে। তিনি কোথাও নিজেকে নায়ক হিসেবে ঘোষণা করেননি। কিন্তু পুরো ঘটনাপ্রবাহে নেতৃত্বের এমন একটি অবয়ব তৈরি হয়েছে, যেখানে দায়িত্ব আগে আসে, বক্তব্য পরে।
এই প্রত্যাবর্তন ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত- এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের ধারণা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। আর কখনো কখনো রাজনীতিতে সেই ভাবনাটাই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়।
লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।





