গ্যাস সংকটের বিরূপ প্রভাব সর্বত্র

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আবাসিক ও শিল্পকারখানায় গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ঢাকার আবাসিক ভবনগুলোতে রান্নাঘরে গ্যাস না থাকায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবনযাত্রায় নানামাত্রিক সংকট দেখা দিচ্ছে। চলমান এ গ্যাস সংকটের কারণে একদিকে শিল্প, বাণিজ্য ও জাতীয় অর্থনীতি বড় ধরণের ঝুঁকিতে পড়েছে। অন্যদিকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময় চুলায় গ্যাস থাকে না। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ফলে ইলেক্ট্রিক কিংবা ইন্ডাকশন চুলায় রান্নার বিকল্প ব্যবস্থাও কাজে আসছে না। এতে কর্মজীবী মানুষের তিন বেলা ঠিক মতো খাওয়া হচ্ছে না। গৃহিনীরা রাতের ঘুম বাদ দিয়ে মধ্যরাতে চুলায় গ্যাসের অপেক্ষায় বসে থাকে। গ্যাসের চাপ (প্রেসার) এতোটাই কম যে, রান্না শুরু না করতেই তা চলে যায়। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং চাকরিজীবী পরিবারগুলো।
আরও পড়ুন: সেনানিবাসের বাড়ি সাবজেল ঘোষণা প্রসঙ্গে ঢিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম
শিশু-কিশোরদের সকালের নাস্তা ও স্কুলের টিফিন, অফিসগামীদের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার রান্না সম্ভব না হওয়ায় সামগ্রিকভাবে পরিবারের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। এমনিতে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করতে পারছে না। তাই পারিবারিক চুলা বন্ধ থাকায় হোটেল থেকে খাবার কেনা, স্কুল-কলেজের টিফিনের বাড়তি ব্যয় নির্বাহ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান সংকট আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে।
সমালোচকরা বলছেন, ব্লু ইকোনমি তথা সমুদ্রের গ্যাস ও তেলক্ষেত্র ব্লকগুলো থেকে বিপুল পরিমান জ্বালানি সম্পদ উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবার কথা ছিল। এর বদলে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় শিল্প কারখানা বন্ধের উপক্রম। গত দেড় দশকে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাসহ অবকাঠামো খাতে যুগান্তকারি উন্নয়নের কথা দাবী করলেও তেল-গ্যাস তথা জ্বালানি খাতে তেমন কোনো উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়নি। হালে গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং নাগরিক জীবন এখন চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে।
আরও পড়ুন: সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত বিজিবি সদস্যকে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর
গত এক দশকে দেশে বেশ কয়েকটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং জাতীয় গ্রীডে এসব গ্যাসের সংযোগের খবর দেখা গেছে। কিন্তু পুরনো আবাসিক লাইনগুলোতে বছরের পর বছর ধরে চলা গ্যাস সংকট নিরসন হয়নি। তবে এ সময়ে লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ দুর্নীতির মাধ্যমে বেহাত হওয়ার তথ্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার ঢাকাঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছে - দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে গত দেড় দশকে এই সেক্টরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে বড় ধরণের পরিবর্তন সূচিত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে গ্যাস ও জ্বালানি খাতে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন না হওয়ায় বিদ্যুতে বিনিয়োগ কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই এমন অবস্থা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চলমান অর্থনৈতিক টানপোড়েন এবং ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুতে রেশনিং ও লোডশেডিং বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে রফতানিমুখী তৈরী পোশাক খাত, নিটিং, ইস্পাত শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতসমুহে । গত দেড় দশকে আবাসিক গ্যাস সংযোগের খরচ প্রায় তিন গুণ বাড়ানো হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো। তাই আবাসিক গ্যাস সংযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। ঢাকার লাখ লাখ গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার না করেই প্রতিমাসে হাজার টাকা গ্যাস বিল পরিশোধ করছেন।
জানা গেছে, বৈধভাবে নতুন গ্যাস সংযোগ পাওয়া না গেলেও প্রতি বছর লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে তিতাস গ্যাসের মাঠ পর্যায়ের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা -কর্মচারি। বলাবলি হচ্ছে- দেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সংখ্যা বৈধ গ্যাস সংযোগের প্রায় কাছাকাছি। এ চিত্র থেকে বুঝা যায়, বৈধ গ্রাহকদের বঞ্চিত করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জনগণের রাজস্বের কোটি কোটি টাকা নিজেদের পকেটে ভরছেন। অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রতিরোধে কঠোর আইন থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ রোধ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালিত হলেও এসব অভিযানে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফল আসছে না।
এদিকে, শিল্পখাতে আবারো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোসাই’ গ্রাম বাংলার এই প্রবাদের মতই পেট্রোবাংলার অবস্থা। এক লাফে গ্যাসের দাম আড়াইগুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে জমা দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
জানা যায়, শিল্পখাতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের বর্তমান দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সামাল দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে এর আগে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি জারি করা নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিন গুণ করা হয়। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা ও ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের আশ্বাস দিয়ে দাম তিনগুণ করা হলেও শিল্প মালিকরা তাদের চাহিদামতো গ্যাস কখনোই পাননি। বরং, গ্যাসের সংকট অনেকাংশেই বেড়েছে। ঢাকার আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে গ্যাস সংকট বেড়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে গ্যাস সংকটের কারণে ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে আছে আরও অন্তত ৩০০টি কারখনা। স্থাপিত অনেক কারখানা চালু করা যাচ্ছে না গ্যাস সংকটে, গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা নতুন শিল্প স্থাপনেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে একদিকে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। উল্টো যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। নতুন কর্মসংস্থানের বদলে দেশে বাড়ছে বেকারত্ব। এই অবস্থায় নতুন করে শিল্পখাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। তার ওপর মূল্য বাড়লেই যে শিল্প-কারখানাগুলো চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ পাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। শিল্পের শোচনীয় অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাবে। উৎপাদন কম হবে বলে, রপ্তানিও কমবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় বিপুলসংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। যেসব টিকে আছে সেগুলোও অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। এ অবস্থায় গ্যাসের তীব্র সঙ্কট শিল্প খাতকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হলে প্রতিটি শিল্প খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়াসহ শিল্প খাতে নানাবিধ নতুন সংকট তৈরি হবে।
তাছাড়া দেশে গ্যাসের চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের বিস্তর ফারাক রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ত্রুটিহীন রেখে এর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন।